বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরী | শনিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘ উদযাপিত বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে স্বীকৃত হয় যে, ‘ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল রোগ যা অনেক মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পরে এবং এ রোগ এখন পরিবার, রাষ্ট্র ও সারা বিশ্বের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে’। অন্যান্য সংক্রামক মহামারীর পাশাপাশি ডায়াবেটিসও একটি অসংক্রামক ব্যাধি হিসাবে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসাবে আজ সারাবিশ্বে স্বীকৃত। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত উপরোক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় : নার্স ও ডায়াবেটিস।
‘আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন’ এবারেও ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’-এ এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, নার্স ও ডায়াবেটিস। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ডায়াবেটিস বড় সমস্যা। বর্তমানে আমাদের দেশে কমবেশি ৮০ লক্ষ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যদি এখনই এ রোগের প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে এই সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক পথ্য চিকিৎসা গ্রহণ করে এ রোগকে সুনিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আর রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিস নিয়েও পরিপূর্ণ জীবন যাপন করা যায়।
ডায়াবেটিস স্বাস্থ্যশিক্ষা

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যশিক্ষাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস এর প্রচারণাসমূহের কেন্দ্রবিন্দু। ডায়াবেটিস একটি জটিল ও জীবনব্যাপী রোগ। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে জীবদ্দশায় অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিতে হয় ডায়াবেটিসকে অগ্রাধিকার দিয়ে। তাই ডায়াবেটিস সম্পর্কিত স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমেই আমরা জীবন যাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক-মানসিক আচরণে সঠিক পরিবর্তন আনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারি। এছাড়া স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে একজন রোগী সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে কর্মক্ষম ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা এড়িয়ে যাবার কৌশলও আয়ত্তে আনতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বব ক্রডিজ নামের একজন ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে দীর্ঘ ৮৫ বছর সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন যাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডায়াবেটিস গবেষণা প্রতিষ্ঠান জসলিন ডায়াবেটিস সেন্টার বব ক্রডিজকে সম্মাননা দিয়েছে। ক্রডিজের শৈশবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা এখনকার মতো এতো উন্নত ছিল না। ইনসুলিন নেয়ার পাশাপাশি খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যায়াম করে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ক্রডিজ বলেন, “আমি শুধু খাওয়ার জন্য বা আনন্দের জন্য খাই না। শরীরকে সচল রাখতে যেটুকু খাবার প্রয়োজন, তা-ই খাই।” অর্থাৎ ব্যালেন্স ডায়েট নেই/খাই।
ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কাদের : টাইপ-১

জন্মগত কিংবা পরিবেশগত কিছু কারণেই টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রকোপ দেখা যায়। বছরে প্রায় ৩ শতাংশ হারে এই ডায়াবেটিস বাড়ছে এবং সাধারণত তরুণরাই এতে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে, কারণ শুধুমাত্র ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যয়ভারই একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার ৫-১০ শতাংশ।
টাইপ-২ : অতিরিক্ত ওজন, মেদবাহুল্য, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, উচ্চ শর্করা ও কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভ্যাস থাকলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে। এছাড়া, পারিবারিক ইতিহাস, জন্মের সময় কম ওজন এবং বয়সে যারা প্রবীণ তাদের মধ্যেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা যায়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

ডায়াবেটিস এর জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব (টাইপ-২) ডায়াবেটিস ৭০% পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিভিন্ন গবেষণায় ডায়াবেটিস প্রতিরোধে যেসব উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে-
ম জীবনযাপনে পরিবর্তন ও সঠিক পরিবেশ
ম পুষ্টিকর ও পরিমিত খাদ্যগ্রহণ
ম শরীর চর্চা
ম যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা
ডায়াবেটিস হওয়ার আগেই যদি সচেতন হয়ে নিয়ম কানুন মেনে চলা যায় এবং শৃংখলাপূর্ণ জীবন যাপন করা যায় তবে বংশে থাকা সত্ত্বেও এই ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমানে নগরায়ন এবং এর ফলে জীবন যাপনের পরিবর্তিত পদ্ধতির কারণে সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃদ্ধির এই হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও বেশি। ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে-
ম কায়িক পরিশ্রম না করা (সামান্য দূরত্বে রিকসায় বা গাড়িতে যাতায়াত)
ম মোটা বা স্থূলকায় হয়ে যাওয়া (বিএমআই >২৭-৫ কেজি/মি. হয়ে যাওয়া)
ম ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখা
ম অতিরিক্ত ফাষ্ট ফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় (সফট ড্রিংকস) পান করা ইত্যাদি।
ডায়াবেটিসের জটিলতা

ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন না হলে এবং এ রোগ নিয়ন্ত্রণ না করলে যে কোন ডায়াবেটিক রোগীর কিডনি, চোখ, হৃদপিন্ড, পা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। দেখা দিতে পারে নানারকম শারীরিক জটিলতা। এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা এবং যথাযথ চিকিৎসার অভাবে অসংখ্য লোক অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করা ছাড়াও অকালে মৃত্যুবরণ করে। অনেক ডায়াবেটিক রোগীর জটিলতার কারণে পায়ে পচনশীল রোগ হতে পারে এবং এর ফলে পা কেটে ফেলার মতো ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। হতে পারে কি বলবো? রীতিমতো কেটে ফেলা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন মিনিটে ৭ জনের পায়ের অপারেশন ঢাকা বারডেমে হচ্ছে। আমাদের এখন আর কষ্ট করে ঢাকায় যেতে হচ্ছে না। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালেই রয়েছে পায়ের সমস্যার সমাধান।
এছাড়াও অসচেতনতার ফলে গর্ভবতী মহিলাদের অপরিণত বা মৃত সন্তােেনর জন্ম হতে পারে। শারীরিক ত্রুটিপূর্ণ শিশুর জন্ম হতে পারে। মাড়ির প্রদাহ হতে পারে। শুধুমাত্র তামাক (ধূমপান ও জর্দা) এড়ানোর মাধ্যমেও ডায়াবেটিসের জটিলতা প্রায় ৩০% কমিয়ে আনা সম্ভব। পরোক্ষ ধূমপানেও সমপরিমাণের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পরোক্ষ ধূমপানে মিনিটে ১ জনের দ্বারা ৪ জন আক্রান্ত হচ্ছে। এর পরিণতি ভয়াবহ। এসব বিষয়ে সচেতন হয়ে এখনই মানুষের উচিত মানবতার বহিঃপ্রকাশ করার।
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের ভূমিকা

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালে ডায়াবেটিক রোগের প্রকোপ এবং প্রসারতা, লাগাম কমানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে রোগী সেবা কার্যক্রমকে রোগীদের দ্বারগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে খুলশীস্থ ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের পাশাপাশি এনায়েত বাজার শাখা, ২) বন্দরটিলা শাখা, ৩) অঙিজেন শাখা এবং ৪) বহদ্দারহাট শাখা স্থাপন সহ উপজেলা পর্যায়ে ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, রাঙামাটি, দোহাজারী, রাঙ্গুনীয়া, সাতকানিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করে সেবা দেয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল ডায়াবেটিক ও নন-ডায়াবেটিক
রোগীদের জন্য নিয়মিতভাবে চালু রয়েছে :

ম অত্যাধুনিক ডায়াগনষ্টিক ল্যাব : নিজস্ব প্যাথলজিষ্ট, মাইক্রোবায়োলজিষ্ট, বায়োকেমিষ্ট, দক্ষ টেকনোলজিষ্ট দ্বারা সকল প্রকার বায়োকেমিষ্ট্রি, প্যাথলজি, হরমোন, সেরোলজি, ইবিউনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি পরীক্ষা করা হয়।
পুরুষ ও মহিলা বিশেষজ্ঞ সনোলজিষ্ট এর মাধ্যমে ৪উ কালার আল্ট্রাসনোগ্রাম, নিজস্ব কার্ডিওলজিষ্ট এর মাধ্যমে ৪উ কালার ইকো-কার্ডিওগ্রাফী, অভিজ্ঞ জঈঙ দ্বারা ডিজিটাল এক্সরে , ৬ ও ১২ চ্যানেল ইসিজি
ইনডোর বিভাগ

৩৫ কেবিন বিশিষ্ট ১৫০ শয্যায় ডায়াবেটিক ও নন-ডায়াবেটিক রোগীদের অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, মেট্রন সহ পরিপূর্ণভাবে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ৫ বেলা খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা।
অপারেশন থিয়েটার

● গাইনী : নরমাল ডেলিভারী, সিজারিয়ান ডেলিভারী, হিষ্টেকটমী, এবডোমিনাল সার্জারী, ডেডিকেটেড লেবার রুম।
ডায়াবেটিস সংক্রান্ত যে কোন সার্জারি

● ফুট কেয়ার ও অর্থোপেডিক সার্জারী , চক্ষু সার্জারি ঃ ছানি অপারেশন (ক্যাটারেক্ট), ল্যাপরোষ্কোপিক সার্জারি : ● নিউরো সার্জারী ● কোলোরেক্টাল সার্জারী, জেনারেল সার্জারী, হার্নিয়া, এপেন্ডিসাইটিস
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল-কে অনেকেই মনে করে থাকেন এখানে শুধুমাত্র ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। বাস্তব সত্য হচ্ছে এই হাসপাতালে ডায়াবেটিক ও নন-ডায়াবেটিক সকল রোগীদের জন্য সমানভাবে চিকিৎসা সেবা চলমান বলেই এটার নামকরণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি- যে রোগী একবার এই হাসপাতালের সেবা পেয়েছে সে ডায়াবেটিক চিকিৎসায় বাইরে কোথাও দেখাবে না। ঢাকায়ও যাবে না। দেশের বাইরেও ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য যাবে না। আমার এই কথা প্রমাণ করার জন্য হলেও একটি বারের জন্য আসুন নিজের চোখে দেখুন এবং আমাদের সেবা গ্রহণ করুন।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধজিয়া পরিবার মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক : শামীম