‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি’ প্রতিবেদন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য

| মঙ্গলবার , ৫ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২২’ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গত বুধবার প্রকাশিত বার্ষিক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী বহু নারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হচ্ছেন। এটি বৈশ্বিক সংকটের চেহারা পাচ্ছে। এই সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘অদৃশ্যকে দেখা’।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পুরুষদের গড় আয়ু ৭২ বছর। আর নারীর ৭৫ বছর। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের চেয়ে তিন বছর বেশি বেঁচে থাকছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে ইউএনএফপিএর পরিসংখ্যানের খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিবিএসের হিসাবে, দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর। পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর এবং নারীর ৭৪ দশমিক ৫ বছর।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ৫০ বছর আগে অর্থাৎ স্বাধীনতার পরপর জনসংখ্যাকে অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে অনেকে দেখেছিলেন। তখন মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) ছিল ৬ দশমিক ৩। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী একজন প্রজননক্ষম নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে টিএফআর ক্রমান্বয়ে কমেছে। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে টিএফআর ছিল ২ দশমিক ৩। ইউএনএফপিএ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশের টিএফআর এখন ১ দশমিক ৯। এর অর্থ একজন প্রজননক্ষম নারী সারা জীবনে দুটির কম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। এটা অনেক বড় পরিবর্তন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা নীতির একটি বড় লক্ষ্য ছিল প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হার অর্জন। টিএফআর ২ দশমিক ১ হলে তাকে প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হার বলে। অর্থাৎ এক দম্পতি দুটি সন্তান রেখে যাবেন। ইউএনএফপিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘ইউএনএফপিএ অনুমিত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে। এটা প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত নয়। মহামারির কারণে অনেক সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাল্যবিবাহ বেড়েছে, কিশোরী গর্ভধারণও বেড়েছে। তাই বাংলাদেশে প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হারে পৌঁছে গেছে, এটা বলার সময় এখনো আসেনি।’
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অপরিণত মায়ের ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ বয়ে আনে মাতৃমৃত্যুঝুঁকি। অধিক বয়সী মায়ের ক্ষেত্রে হতে পারে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ইনফেকশনসহ বিভিন্ন জটিলতা। সেই সঙ্গে যেকোনো বয়সে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি অপরিকল্পিত গর্ভধারণ আনতে পারে বাচ্চা ও পরিবারের জন্য সামাজিক ও মানসিক চাপ। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক মায়ের গর্ভস্থ শিশুর হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। সাধারণ শিশুর তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। এসব শিশুর জন্মগত হৃদ্‌পিণ্ডের ছিদ্র, ভাল্বের ত্রুটি, গঠন ও রক্তনালির ত্রুটি, পেশির বাড়তি বৃদ্ধি এবং পারসিসটেন্ট পালমোনারি হাইপারটেনশনের মতো হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইউএনএফপিএ বলেছে, কোনো শিশুর জন্য পরিকল্পনার বাইরে গর্ভধারণই হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। এর পেছনে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, নীতি ও আইন, সংস্কৃতি এবং জনমিতিক চরিত্র কাজ করে। ইউএনএফপিএ বলছে, প্রতিটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ যে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই ফল, তা কিন্তু নয়। তবে প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পাওয়া, পদ্ধতি পছন্দ করা, সন্তান ধারণের সময় বেছে নেওয়া, সন্তানের সংখ্যা ঠিক করা-এসবই অধিকারের মধ্যে পড়ে। বৈশ্বিকভাবে ১ হাজারের মধ্যে ৬৪টি গর্ভধারণ অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশে তা ৫৯।
অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুরুতেই আনমেট নিড এর কথা বলতে চাই। আনমেট নিড বলতে বুঝায়- সেই সক্ষম নারীদের যারা সন্তান গর্ভধারণ করতে চান না (এখন বা একেবারেই না), কিন্তু কোন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিও ব্যবহার করছেন না। বর্তমানে প্রতি ১০০ জন প্রজননক্ষম নারীদের মধ্যে ১২ জন এবং কিশোরীদের মধ্যে (১৫-১৯ বছর) ১৭ জনের আনমেট নিড রয়েছে। আমরা যদি আনমেট নিড পূরণ করতে পারি তাহলে ৭৫% অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপরিকল্পিত সন্তান ধারণ, সন্তান জন্ম ও গর্ভপাত কমাতে পারবো। এছাড়া ৩৫% মাতৃ মৃত্যু বা নারী মৃত্যু কমাতে পারবো। সারা পৃথিবীতে চালানো গুটমাকার ইন্সটিটিউট এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, আনমেট নিড পূরণ করলে প্রতিবছর তা- ২১৮ মিলিয়ন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভ রোধ করে, ৫৫ মিলিয়ন অপরিকল্পিত জন্ম রোধ করে, ১.৪৮ মিলিয়ন অনিরাপদ গর্ভপাত কমায়, ১১৮,০০০ মাতৃমৃত্যু রোধ করে বা কমায়, ১.১ মিলিয়ন শিশুমৃত্যু রোধ করে। তাই দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে