সুদীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়ে থাকে। ঋতু বৈচিত্র্যের এদেশে সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। এ সময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অনেক সময় মৌসুমী বায়ু প্রবাহের আগ মুহূর্তে অথবা বিদায়ের পরপরই স্থলভাগে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো কিংবা সাগরে নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়। যাতে বাংলাদেশ প্রায় সময় আক্রান্ত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের এই স্বাভাবিক চিত্রটি এখন বদলে যাচ্ছে। ষড়ঋতুর এ দেশে এখন অনেক সময় বর্ষা প্রলম্বিত হচ্ছে, আবার অনেক সময় অসময়ে বৃষ্টিপাত হয়ে বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনও কোনও সময় শরৎকালে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার পরিবর্তে তীব্র তাপদাহ হচ্ছে, শীতকালে শীত না পড়ে আবহাওয়া গ্রীস্মের মত আচরণ করছে।
আজকের লেখায় আমরা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট, বাংলাদেশে প্রভাব এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
জলবায়ু সংকট বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একটি বড় সমস্যা। ক্রমাগতভাবে পৃথিবীর উপর এর প্রভাব উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েই চলেছে। সমপ্রতি নেতৃস্থানীয় মার্কিন জলবায়ু বিজ্ঞানীদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সাল ছিল বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষের জন্য সর্বোচ্চ উষ্ণতার বছর। জলবায়ু পরিবর্তন জীবিকা, অবকাঠামো এবং আবাসন ধ্বংস করছে, মানুষজনকে তাদের বাড়ি, শহর এমনকি দেশ থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য করছে। শুধু গত ২০১৬ সালে চরম আবহাওয়া বিপর্যয়ে সারা বিশ্বে প্রায় ২৩.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যত হয়েছে। আর এসব ক্ষতিকর প্রভাবের প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২৪ সালের মে ও জুন মাসে বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা লক্ষ্য করা গেছে, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, হিট স্ট্রোকে অনেক জীবনহানি হয়েছিল। আবহাওয়ার এরকম বিরূপ আচরণ শুধু বাংলাদেশে নয় প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তানেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১০০ বছরের তাপমাত্রায় গত মে মাস ছিল ভারতের জন্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড যা নজিরবিহীন। একই ঘটনা পাকিস্তানেও লক্ষ্যণীয়। এ সময় ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে ৪৯ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাকিস্তানের জ্যাকোবাবাদ শহরে তাপমাত্রার পারদ চড়েছিল এপ্রিল মাসে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় যেখানে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অধিক পরিমাণ বনায়নের উপর জোর দেওয়া উচিত বাস্তবে ঘটে চলেছে তার উল্টোটা। সাধারণত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যেকোনো দেশের ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছর যে হারে বনভূমি কমছে তাতে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব বাড়ছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে বনআচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২.৮%।এ অবস্থায় সরকার ঘোষিত মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা করে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা এখনো পূরণ করা যায়নি। উপরন্তু যেটুকু সংরক্ষিত বন আছে তাও উজাড় হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। একদিকে দখলদারদের থাবা পড়েছে এসব বনে আর অন্যদিকে নানা প্রকল্পেও নেওয়া হয়েছে সংরক্ষিত বন ধ্বংসের আয়োজন। বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০একর। দখলদাররা সারাদেশে বনের জমি জবরদখল করে রেখেছেন ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি। এদিকে গত ৫ জুলাই ২০২৪ ইংরেজি তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে ১ হাজার ১০ একর প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ করার মহোৎসবে মেতে উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে গত পাঁচ দশকে বনাঞ্চলের ঘনত্ব কমেছে ২.৭%। ‘রাইজিং টাইডস, রোরিংফিউচারস: দা সুন্দরবনস কোয়েস্ট ফর সার্ভাইভাল– ২০২৪’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ভূমি আবরণে পরিবর্তন ঘটেছে। ঘন বনের পরিমাণ কমে গেছে, আর জলাভূমির আয়তন বেড়েছে। ১৯৭৩ সালে সুন্দরবনের ৯৪.২ শতাংশ এলাকা গণ বনাঞ্চলে আবৃত ছিল, যা ২০২৪ সালে কমে ৯১.৫ ভাগ হয়েছে।
এধরনের প্রেক্ষাপটে সমপ্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ‘জলবায়ু ন্যায্যতা প্রদান: ত্বরান্বিত উচ্চ আকাঙ্ক্ষা এবং অভিযোজন ও সবার জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ জলবায়ু সংকট এড়াতে শীর্ষ ধনী দেশগুলোকে ন্যায্য অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করার আহবান জানিয়েছে। অন্যদিকে, এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বন্যা সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাইমেট সেন্ট্রাল এর গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যার আঘাতের শিকার হবে বাংলাদেশের ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ। বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের ভূ–প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ নদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এভাবে দেখা যায়, প্রতিবছরে গড়ে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এদেশের কৃষি খাতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে নদী ভাঙ্গনের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহুরে বস্তিতে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ৫০ ভাগই নদী ভাঙ্গনের শিকার। ফলে তারা তাদের গ্রামীণ বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নিম্ন চাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মানুষের জীবনহানিসহ ঘরবাড়ি, সম্পত্তি ও অবকাঠামোর ক্ষতি এবং কৃষি ও অন্যান্য জীবিকাকে ব্যাহত করে। ফলে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ২০০০ লোক বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। শ্বাসকষ্ট, হিট স্ট্রোক কিংবা তীব্র ঠাণ্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমণ্ডলীয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রভাবিত হবে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বর্ধিত হারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। সকল আশ্রয়হীন বাস্তুহারা মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে দেশের নিকটবর্তী বড় বড় শহরগুলোতে। ফলে বাড়ছে সেসব শহরের জনসংখ্যা এবং নানাবিদ সংকট।
সবশেষে বলতে চাই, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা বিশেষ কোনও দেশ বা অঞ্চলের নয় এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের দেশে দেশে পরিবেশ দূষণ, বন্যা, তাপদাহ, কার্বন নিঃসরণ, নতুন নতুন ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার আগমন ও ইকো সিস্টেমের ভারসাম্যহীনতার ফল। তাই আমাদেরকে এখনই এই সমস্যার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে এবং পরিবেশ সচেতন হতে হবে। আমাদের সরকার এবং আমাদের জনগণকে আমাদের পরিবেশ রক্ষায় এখনই উদ্যোগ হতে হবে।
লেখক : অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ; প্রধান উপদেষ্টা, রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।