বিশ্ববাজারে প্রবেশে সক্ষম এমন পণ্যের সম্ভার বাড়াতে হবে

| শনিবার , ৪ মার্চ, ২০২৩ at ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

টানা তিন মাস ৫০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হলেও গত মাসে তা কমে গেছে। যদিও পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, সদ্য বিদায়ী ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৬৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি।

পণ্য রপ্তানির এই হালনাগাদ পরিসংখ্যান বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশ করেছে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাইফেব্রুয়ারি) ৩ হাজার ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৬৩২ কোটি টাকার সমান। এই রপ্তানি

গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা ও প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। তার বিপরীতে পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং হিমায়িত খাদ্যের রপ্তানি কমে গেছে।

গত বছর রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসে। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ক্রয়াদেশ কমতে থাকে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশে গ্যাসবিদ্যুতের সংকট প্রকট হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে দিনের একটি বড় সময় উৎপাদন ব্যাহত হয়। এত সংকটের মধ্যেও পণ্য রপ্তানিতে

চলতি অর্থবছরের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। প্রথম দুই মাসে ৮৫৯ কোটি ডলার পণ্য রপ্তানি হয়। প্রবৃদ্ধিও ছিল ২৫ শতাংশ। যদিও সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। অক্টোবরে তা আরও ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমে যায়। নভেম্বরে আবার ইতিবাচক ধারায় ফেরে রপ্তানি। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে পণ্য

রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫০৯, ৫৩৭ ও ৫১৪ কোটি ডলার। তার মধ্যে ডিসেম্বরে যে পণ্য রপ্তানি হয়, তা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাইফেব্রুয়ারি সময়ে ৩ হাজার ১৩৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই

সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ৮৩ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা আর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটের মুখে রপ্তানি আয় আর রেমিট্যান্স প্রবাহের গতিপ্রকৃতির দিকে এখন সবার নজর। গত দুই মাসে রপ্তানি আয়ের আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি হলেও সদ্য বিদায়ী মাসে রপ্তানি আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতায় সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা

করছেন অনেকেই। রপ্তানি আয়ের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য রপ্তানির নতুন গন্তব্য সৃষ্টি কিংবা বিদ্যমান গন্তব্যগুলোকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া রপ্তানির ঝুড়িতে বিশ্ববাজারে প্রবেশে সক্ষম এমন পণ্যের সম্ভার বাড়াতে হবে।

অর্থনীতি, উন্নয়ন ও বাণিজ্য বিষয়ক লেখক মকসুদুজ্জমান লস্কর এক লেখায় বলেছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সমপ্রসারণ করা বেশ কঠিন। চীন, ভারতসহ প্রতিশ্রুতিশীল বাজারে প্রবেশের জন্য এসব দেশের

চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিয়েতনাম চীনে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের টেলিফোন, মোবাইল ফোন এক্সেসরিজ, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে এসব পণ্য উৎপাদন হয় না বললেই চলে। ভিয়েতনাম বিগত ২০ বছরে এ

খাতে বিশ্বের রপ্তানিতে ৪৭তম স্থান থেকে ১০ম স্থানে উন্নীত হয়েছে এবং এর পটভূমি হিসাবে রয়েছে স্বল্পমজুরি, উৎসাহমূলক কর সুবিধা, বিশ্ববাজারের সমর্থন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পাদিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। স্যামসাং, এলজি ও ক্যাননের মতো বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড ভিয়েতনামে তাদের প্ল্যান্ট স্থাপন

করেছে। এছাড়া ইন্টেল ভিয়েতনামে প্রসেসর ও ইলেকট্রনিক্স চিপস তৈরির প্লান্ট চালু করেছে। ভিয়েতনাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে ইলেক্ট্রনিক্স তৈরি করে আবার রপ্তানি করে থাকে। ভিয়েতনাম এখন বিশ্বের স্মার্টফোন উৎপাদনের একটি বড় হাব হিসাবে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশেরও উচিত এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সুবিধা দেওয়া। যেমন১৫ বছরের জন্য কর সুবিধা, প্রশ্নবিহীন বিনিয়োগ সুবিধা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, চীনজাপানভারতসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিসম্পাদন এবং বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোকে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এ খাত দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বিশাল অবদান রাখতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সব পণ্য বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় চীনের বাজারে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজার হতে পারে চীন বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। এ জন্য সরকারিবেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন সংশিল্‌ষ্টরা।

বাংলাদেশের নিট পোশাক শিল্পমালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতের বাজারে আমাদের রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, চীনের বাজারেও আমরা যদি সেভাবে প্রবেশ করতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনের দিকে তাকাতে হবে না। ইউরোপআমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে