বিশেষায়িত চিকিৎসায় আলাদা স্ট্রোক ইউনিট চমেক হাসপাতালে

স্ট্রোক পরবর্তী প্রতিটা মুহূর্তই মূল্যবান

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বব্যাপী একটি আতংকের নাম স্ট্রোক। চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি রোগ। যদিও অনেকে এটিকে হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন।
যা সঠিক নয়। মস্তিষ্কের কোনো স্থানের রক্তনালি বন্ধ হয়ে গেলে বা ব্লক হলে ওই স্থানের রক্ত সঞ্চালন (প্রবাহ) বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের ওই বিশেষ এলাকা অকেজো হয়ে পড়ে। যা স্ট্রোক হিসেবে পরিচিত। স্ট্রোক কোনো সাধারণ রোগ নয়, ব্যক্তি স্ট্রোক করলে তার ক্ষয়ক্ষতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়ে থাকে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আজ ২৯ অক্টোবর, বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সময় মূল্যবান’ (প্রেসিয়াস টাইম)। চট্টগ্রামেও নানা কর্মসূচিতে দিবসটি পালন করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। দিবসটি উপলক্ষে র‌্যালি ও সেমিনারের আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোলজি (নিউরোমেডিসিন) বিভাগ। আগামীকাল রোববার এসব কর্মসূচি পালন করবে বিভাগটি।

তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন এ দিবস পালন করে। ২০১০ সালে স্ট্রোককে পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য-স্ট্রোক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। আর স্ট্রোকের প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে মৃত্যুর দিক থেকে হৃদ্‌রোগের পরেই স্ট্রোকের অবস্থান এবং শারীরিক অক্ষমতার জন্য স্ট্রোক সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। যাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধকোটি মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রায় অর্ধকোটি মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। স্ট্রোক কতটা ভয়ানক মরণব্যাধি, তা এসব তথ্যেই স্পষ্ট বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের জীবনের যেকোনো সময় স্ট্রোক হতে পারে। তবে ৪০ বছরের পর থেকে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। বংশগতভাবেও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এই ঝুঁকি নিয়মিত বেড়েই যাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটা ৮০ ভাগ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২০১৭ সালের একটি সমীক্ষার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজারের মধ্যে প্রায় ১১ দশমিক ৩৯ জনের স্ট্রোক হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যাই বেশি এবং নারীদের তুলনায় পুরুষ প্রায় দ্বিগুণ। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস কিংবা হৃদ্‌রোগ ছিল অথবা তাঁরা ধূমপান, অ্যালকোহল বা অন্য কোনো তামাক সেবন করতেন। এই সব কটি কারণই কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

চিকিৎসকরা বলছেন, কিছু প্রাথমিক লক্ষণ দেখে কোনো ব্যক্তির স্ট্রোক হয়েছে কি না তা ধারণা করা যায়। যেমন হঠাৎ কারও শরীর এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া বা মুখ বেঁকে যাওয়া অথবা কথা জড়িয়ে যাওয়া স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণ। কখনো কখনো তীব্র মাথাব্যথা, যা আগে কখনো হয়নি, মাথা ঘোরানো কিংবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়াও স্ট্রোকের অন্যতম লক্ষণ হতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ যদি কারও মধ্যে দেখা যায়, তাহলে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কারণ, প্রথম সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনতে পারলে বিশেষ কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু সময় পার হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষগুলো স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এজন্য স্ট্রোক সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো খুব বেশি জরুরি জানিয়ে চমেক হাসপাতালের নিউরোমেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কায়স্থগীর বলেন, স্ট্রোকের পরপর যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কারণ স্ট্রোক পরবর্তী প্রতিটা মূহুর্তই মূল্যবান। তাই কোনোভাবেই সময় নষ্ট করা যাবেনা। কোনোভাবেই যেন সাড়ে চার ঘণ্টা অতিক্রম না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এদিকে, স্ট্রোকের রোগীদের বিশেষায়িত সেবায় চমেক হাসপাতালের নিউরোমেডিসিন বিভাগে আলাদা স্ট্রোক ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। আটটি শয্যায় এই ইউনিটে স্ট্রোকের শিকার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

যদিও দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত নিউরোমেডিসিন বিভাগের এই স্ট্রোক ইউনিটে সরাসরি ভর্তির সুযোগ রয়েছে। আড়াইটার পর আর সরাসরি ভর্তির সুযোগ থাকেনা। ওই সময়ে কোনো রোগী আসলে তাদের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি দেয়া হয়। জনবল সংকটের কারণে ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক রোগী ভর্তি কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন নিউরোমেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা।

বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রারের দুটি পদই শূন্য জানিয়ে সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কায়স্থগীর বলেন, জুনিয়র চিকিৎসকদের মাঝে কেবল একজন রেজিস্ট্রার এবং আরেকজন আইএমও রয়েছে। আমাদের ইচ্ছে থাকলেও কেবল জনবল সংকটের কারণে ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছেনা। সার্বক্ষণিক ভর্তি নেয়া সম্ভব হলে রোগীরা উপকৃত হতেন।

জানতে চাইলে চিকিৎসক সংকটের কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত। দুপুরের পর নিউরোমেডিসিন ও কিডনিসহ বেশ কয়টি ওয়ার্ডে সরাসরি রোগী ভর্তি নেয়া হয়না। জনবল (চিকিৎসক) সংকটের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছেনা। বিষয়টি নিয়ে এরইমাঝে আমরা কয়েকবার আলোচনা করেছি। খুব শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা আশা করছি।

প্রতিরোধ যেভাবে :
চিকিৎসকরা বলছেন, মস্তিষ্কের রক্তনালির সমস্যার কারণে স্ট্রোক হয়ে থাকে। সমস্যা দুই ধরনের হতে পারে। কখনো কখনো রক্তনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে। স্ট্রোক কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ নয়। এটা হঠাৎ করেই হয়। হঠাৎ করে কথা জড়িয়ে গেলে অথবা শরীরের কোনো অংশ অবশ হয়ে গেলে বুঝতে হবে, তাঁর স্ট্রোক হয়েছে। এ রকম হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ৪০ বছরের পর থেকে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। বংশগতভাবেও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া নারীদের তুলনায় পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ। এগুলো সবই অপরিবর্তনশীল ঝুঁকি। তবে কিছু ঝুঁকি আছে যেগুলো পরিবর্তনযোগ্য। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চবির্র আধিক্য, স্থূলতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ধূমপান বা বিভিন্ন ধরনের তামাক সেবন ইত্যাদি। এসব কারণ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এক্ষেত্রে আরো সচেতন হতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বকাপে প্রথমবার বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে মুখোমুখি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড সচিব অবসরে, পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ