বিপর্যয় থেকে বাঁচতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি

আতঙ্কে পরিণত হয়েছে বায়ুদূষণ

| শুক্রবার , ২২ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব শুধু মারাত্মকই নয়, সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশগত কারণে ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণের সম্মিলিত প্রভাব প্রতি বছর ৬৭ মিলিয়ন মানুষ অকাল মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। বায়ুদূষণ মানব শরীরের সব প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, কিডনি ইত্যাদিকে আক্রান্ত করে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে যা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। বায়ুদূষণ অসংক্রামক রোগগুলোর অন্যতম কারণ। গত ১৯ মার্চ দৈনিক আজাদী ও দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে দেশ হিসেবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা। নগর হিসেবে একেবারে শীর্ষ অবস্থানটি ছিল ভারতের রাজধানী দিল্লির। মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক আইকিউএয়ারের সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে। বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপাদান ধরেই এই বায়ুর মান নির্ণয় করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.) উপস্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৬ গুণ বেশি। দেশের নিরিখে বাংলাদেশের পরই আছে পাকিস্তান। দেশটির বায়ুতে ২০২৩ সালে পিএম ২.এর উপস্থিতি ছিল ৭৩ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম।

এতে আরো বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে শুধু অস্ট্রেলিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রেনাডা, আইসল্যান্ড, মরিশাস ও নিউজিল্যান্ড বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড বজায় রাখতে পেরেছে। ১৩৪টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার নজরদারি স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইকিউএয়ার প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

পরিবেশবিশেষজ্ঞ ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিরোজ খান বলেন, ‘আইকিউএয়ারের এই প্রতিবেদন একটি অশনিসংকেত। আমাদের নগর আর পুরো দেশের জন্যই জরুরি ভিত্তিতে বায়ুদূষণরোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব উৎস থেকে দূষণ হচ্ছে, সেখানে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর সময় এসেছে। এখানে কোনো আপসের সুযোগ নেই।’

শুধু ঢাকা নয়, আসলে উদ্বেগজনকভাবে পরিবেশ দূষণের কবলে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীও। করোনা মহামারির সময়ে সাধারণ মানুষ এবং যানবাহনের চলাচল কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং ধূলি ধূসরিত রাস্তাগুলো থেকে উৎসারিত ধূলি কমে গিয়েছিল। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ ও শব্দদূষণ যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবারও মানুষের জীবনযাত্রা এবং যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসার কারণে নতুন করে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে পরিবেশ, বায়ু এবং শব্দদূষণ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে হার্ট অ্যাটাক থেকে আর বাকি ২৫ শতাংশ ফুসফুস রোগে মারা যায়। বায়ু দূষণের মাত্রা এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। দূষণের শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। এটা আমাদের জন্য বড় দুঃখজনক। হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায় শুধু বায়ু দূষণের কারণে। সর্বত্র গাড়ির ধোঁয়া, না হয় কলকারখানার ধোঁয়া। তবে এসবের চেয়েও বেশি দূষণ করছে নগরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ইটভাটাগুলো। ফলে যেদিক থেকেই বায়ু প্রবাহিত হোক, দূষিত বায়ু প্রবেশ করছে শহরে। এ যেন দূষণের মেলা চলছে বাতাসে!

পরিবেশবিদরা বলেন, সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষায় ভারসাম্য রক্ষা করেই আমাদের চলতে হবে। পরিবেশকে এড়ানোর সুযোগ নেই। আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী অন্যতম জটিল ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সঙ্গত কারণে পরিবেশউন্নয়ন সম্পর্কটি তাই প্রায় সব আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যেও পরিবেশ সংরক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ওই বৈশ্বিক লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশও অঙ্গীকারাবদ্ধ। আশার কথা, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সকলেই সোচ্চার হয়ে উঠছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আইন। তবে শুধু আইন প্রণয়ন করলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। সেজন্যে জনসাধারণকে পরিবেশ দূষণ বিষয়ে যে সচেতন হতে হবে, সেটি বলাই বাহুল্য। বায়ুদূষণে দেশের এমন দুঃসহ পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও তেমন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বায়ুদূষণ বর্তমানে একটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে