বিপদে যারা করেনি ভয়

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৮ মার্চ, ২০২১ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

এক বছর ধরে মহামারী। এমন মৃত্যুর মিছিল পৃথিবীর মানুষ দেখেনি। দুর্যোগের সময় মনুষত্বের পরীক্ষা হয়। পরস্পরকে সহায়তা করার, মানবতা প্রদর্শনের অফুরন্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। আর এসব দৃষ্টান্ত শোনায় মানবতার বাণী। করোনা বদলে দিয়েছে আমাদের আগের বহু অভ্যাস। বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে যাপিত জীবনে। গত বছর ৮ মার্চ থেকে চারদিকে যেন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল। করোনা প্রতিরোধের কড়াকড়িতে কর্মহীন ছিলেন চট্টগ্রামের নিম্নআয়ের অনেক মানুষ। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে, তাই নিয়ে যত দুশ্চিন্তা। এমন সংকটে ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে, বন্দরনগরীর পথে নেমেছেন মানবিক কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন। তাদের কেউ দিয়েছেন চাল-ডাল, কেউ সাধারণ মানুষের জন্য বানিয়েছেন জীবাণুনাশক। করোনা শুরুর পর থেকে সংক্রমণের লাগাম টানতে শুরু হয় লকডাউন। চট্টগ্রামে গত বছর ৪ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করা হয়। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে লকডাউন দেওয়ায় খাদ্যাভাবে ভুগতে হয় গৃহবন্দিদের।
সংক্রমণ বাড়তে থাকলে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১০ এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্ত জোন ভাগ করেও সুযোগ-সুবিধা না রাখায় লকডাউনে যেতে পারেনি চসিক। এই সংকটে আলোর পথ দেখিয়েছে কিছু উদ্যোগ। আয়হীন মানুষদের কয়েকদিনের আহারের সামগ্রী তুলে দিতে ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে পথে নামে মানবিক কিছু মানুষ। যার মিছিলে আছেন স্বেচ্ছাসেবী আর গণমাধ্যমকর্মীরাও। বাজারে যখন জীবাণুনাশক পণ্যের সংকট, তখন অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি করা হয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সামর্থ্য অনুযায়ী উদ্যোগ নিয়ে সবাই এগিয়ে এসেছে বলেই মানুষ সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।
প্রথমেই বলতে হয় করোনার সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তার ও নার্সদের কথা। এছাড়া করোনা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। লকডাউন বাস্তবায়ন করতে পুলিশ বল প্রয়োগের পরিবর্তে নেয় নানা কৌশল। যাতে মানুষ ঘরে থাকে। কোনো শহর, এলাকা, প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়ি লকডাউন ঘোষিত হলে তা নিশ্চিত করা, বিদেশ ফেরত কিংবা অন্যভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষকে ঘরে থাকা নিশ্চিত করা, আইসোলেশন নিশ্চিত করা, অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে প্রেরণ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, গর্ভবতী মহিলাদের হাসপাতালে আনা-নেয়া, চিকিৎসক ও চিকিৎসার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে বাসস্থান হতে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছানো, অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ওষুধ ও খাবার সামগ্রী পৌঁছানো, ত্রাণ বিতরণ, নিজস্ব উদ্যোগে টেলিমেডিসিন সেবা, করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ পরিবহন ও যথাযথ মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করছে পুলিশের সদস্যরা। পুলিশের সেবা হটলাইন ৯৯৯-এ ফোন করে এ দুর্যোগ মুহূর্তে মানুষ পেয়েছে তার কাক্সিক্ষত সেবা।
লাঠির বদলে উপহার সামগ্রী, জরিমানার বদলে মাইক, কঠোরতার বদলে কাউন্সেলিং কিংবা নেচে গেয়ে মানুষের মন জয় করে মানুষকে ঘরে রেখে জীবন বাঁচানোর দাওয়াই-এ যেন অন্যরকম এক পুলিশিং ব্যবস্থা। এ রকম ব্যবস্থা নিয়েই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ করোনা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খোলা মাঠে কাঁচাবাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর দোকান বসিয়ে জনগণের সুবিধা নিশ্চিত করার মতো কাজ করেছে সিএমপি।
চারদিকে শুধু শঙ্কা। স্বাভাবিক মৃত্যুও যেন করোনা আতঙ্কে আচ্ছাদিত। মানুষ লাশের কাছে ভিড়ছে না। মহানগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ বিংবা অন্য কোনো সংস্থা এগিয়ে আসেনি। রাস্তায় পড়ে থাকা নিথর প্রাণহীন দেহের একমাত্র সহায় সিএমপির মানবিক সদস্যরা। জীবনের মায়া তুচ্ছ জ্ঞান করে পুলিশ সদস্যরা সেসব লাশের কাছে যাচ্ছেন, মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। লাশের ওয়ারিশ বের করা এবং যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় দাফনের কাজটিও করেছেন তারা।
জুনের মাঝামাঝি করোনা চিকিৎসায় অনেকটা বেসামাল অবস্থা ছিল। একদিকে সরকারি কোভিড হাসপাতালে ঠাঁই নেই অবস্থা, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো নানা কৌশলে করোনা তো বটেই, সাধারণ রোগীও ভর্তি করছিল না। একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছিলেন করোনা রোগীরা। এই অবস্থয় এগিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রামের ১২ তরুণ-তরুণী। মাত্র ১০ দিনের প্রচেষ্টায় হালিশহরের পোর্ট কানেকটিং সড়কে প্রিন্স অব চিটাগাং নামের একটি কমিউনিটি সেন্টারে গড়ে তুললেন ১০০ শয্যার করোনা আইসোলেশন সেন্টার। সরকারি অনুদান, সরকারি চিকিৎসক ও সেবিকা ছাড়াই সমাজের মানবিক মানুষের সহায়তায় এই হাসপাতাল যাত্রা করে। উদ্যোক্তাদের সততা ও পরিশ্রম, চিকিৎসকদের মানবিকতা এবং সেবিকা ও স্বেচ্ছাসেবীদের আন্তরিকতার কারণে করোনা চিকিৎসায় বড় ভরসা হয়ে উঠেছিল এটি।
করোনায় মৃতদের সৎকারে যখন স্বজনদের পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সৎকার করতে এগিয়ে আসে আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে গাউসিয়া কমিটি সকল সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি, সুরক্ষা উপকরণ বিতরণ ও সামর্থ্যহীন মানুষদের সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। তারই আলোকে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফনে গণমানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গ করছেন গাউসিয়া কমিটির নেতাকর্মীরা।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ও উপসর্গে মৃত মুসলমানদের দাফনের পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সৎকারে সহযোগিতা করে শেষ যাত্রায় সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে গাউছিয়া কমিটি। কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরা কারও লাশ হাসপাতাল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন, কাউকে শেষ গোসল দিয়ে পোশাক পরিয়েছেন, আবার কাউকে কাঁধে করে চিতায়ও নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত শত শত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী করোনা রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেন সরবরাহ করেছেন তারা।
এছাড়া চট্টগ্রামে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন করোনায় মারা যাওয়া রোগীর লাশ ধোয়া থেকে কাফন দাফন সবকিছু করছে। সীতাকুণ্ডে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফনের দায়িত্ব নিয়েছে ওলামা পরিষদ ও গাউছিয়া কমিটি নামে দুটি সংগঠন। এগিয়ে আসেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরাও। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয় কোয়ান্টাম স্বেচ্ছাসেবকদের লাশ দাফন কার্যক্রম। ফাউন্ডেশনের তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক সারা দেশে মরদেহ দাফন ও সৎকারে ব্যস্ত। চট্টগ্রামে এ কার্যক্রম শুরু হয় ২৩ মে থেকে।
করোনার শুরুর দিকে চট্টগ্রামে মরদেহ দাফনে আশীর্বাদ হয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসআইপিএফ মুর্দাসেবা। খবর পাওয়ামাত্রই তারা ছুটে গেছে শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্ব এবং নির্দেশনায় সবকিছু ছাপিয়ে অন্য দেশের তুলনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে আবার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসতে শুরু করে। ভয়কে জয় করে সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় মানুষ। এক পর্যায়ে ২০ জানুয়ারি দেশে আসে করোনাভাইরাসের টিকা। ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।
করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারকে এরই মধ্যে সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে দেশ থেকে এখনো করোনা বিদায় নেয়নি। বর্তমানে সংক্রমণ কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সতর্কতায় শিথিলতা দেখানো যাবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকদিন পিছাল মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন
পরবর্তী নিবন্ধনগরীতেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি