বিদ্রোহী কবি নজরুল

আরিফ রায়হান | বুধবার , ২৫ মে, ২০২২ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী। এ দিনে দুই বাংলায় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় কবিকে স্মরণ করা হয়। কাজী নজরুল বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক প্রতিভার এক অনন্য নাম। তিনি গেয়েছেন সাম্যের জয়গান, মানবতার জয়গান। ফলে তিনি জাতীয় কবি ছাড়াও একাধারে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি ও মানবতার কবি। তাঁঁর কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, সাংবাদিকতা, নাটক, চলচ্চিত্র প্রভৃতিকে ঋদ্ধ করেছে। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর কবিতা ও গান আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে।

কবি নজরুল শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করার জন্য আজীবন সেচ্চার ছিলেন। গণমানুষের অধিকার আদায়ে নির্যাতন সহ্য করেছেন, কারাবরণ করেছেন।

কবি নজরুল ছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনার অগ্রপথিক। যখন অখণ্ড ভারতবর্ষে ধর্মীয় এবং সামাজিক দিক থেকে হিন্দু-মুসলমানদের বিভাজন প্রকট আকার ধারণ করে তখন তিনি সাহিত্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে দুই সমপ্রদায়ের মধ্যে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির মেলবন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। তিনি মুসলমানদের জন্য যেমন লিখেছেন ইসলামী সঙ্গীত ঠিক তেমনি হিন্দু সমপ্রদায়ের জন্য রচনা করেন শ্যামা সঙ্গীত।

কবি নজরুলের জন্ম বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। অতি দরিদ্রের মধ্যে কেটেছে তাঁর কৈশোরকাল। এ কারণে তাঁকে ডাকা হয় ‘দুখু মিয়া নামে’। গ্রামের এক মক্তবে আরবী শিক্ষা আয়ত্ব করার সুবাদে মসিজদের ইমাম ও মাজারের খাদেমের দায়িত্ব পালন করেছেন শৈশবের কিছু সময়। এ পেশায় থেকে দারিদ্র্যকে জয় করতে না পেরে যোগ দেন লেটোগানের দলে। তখন কিশোর নজরুল গান গেয়ে সবার মন কাড়তে সক্ষম হন। লেটোগানের দলে বেশি দিন স্থায়ী না হলেও এখান থেকে গীত রচনায় দীক্ষা লাভ করেন তিনি। এক সময় কবি প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের জন্য ভর্তি হন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউটে। লেখাপড়ার প্রতি কবির প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও ‘দারিদ্র’ তাঁর এ মহান ইচ্ছাকে বার বার বাধাগ্রস্ত করে।

কবি নজরুলের জীবন ছিল অভাব অনটন আর সংগ্রামে পরপিূর্ণ। আর্থিক দৈন্যতার কারণে লেখাপড়া ছেড়ে চাকরি নেন একটি রুটির দোকানে। একদিন এ দোকানে নাস্তা করতে আসেন এক পুলিশ সদস্য। তিনি কিশোর নজরুলের কষ্ট দেখে তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান ময়মনসিংহ জেলার কাজীর সিমলা গ্রামের দরিরামপুর হাই স্কুলে। বছর খানেক এ স্কুলে অধ্যয়ন করে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ফিরে যান নিজ গ্রাম চুরুলিয়ায়। এরপর ভর্তি হন রানীগঞ্জ শিয়ারশোল হাই স্কুলে। এ সময় তিনি সাহিত্য চর্চায় বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেন। দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে চাকরি নেন সেনাবাহিনীতে। তিনি এ বাহিনীর ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করেন।

সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তাঁর বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হতে থাকে পত্র-পত্রিকায়। সাহিত্য চর্চার সাথে উর্দু, হিন্দি ও ফারসী ভাষাও আয়ত্ব করেন কবি নজরুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং পুরোদমে সক্রিয় হয়ে উঠেন সাহিত্য চর্চায়। এ সময় তিনি কবিতা, গান, প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক কমরেড মুজাফফর আহমদের সাথে থেকে সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত হন নজরুল। তাঁরা দুজনে ‘নবযুগ’ নামে একটি সান্ধ্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। এছাড়া তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো ‘যুগবাণী’ নামে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হলে ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করে। ‘যুগবাণী’ বাজেয়াপ্ত হলে এ সালের ১১ আগস্ট নজরুল ‘ধুমকেতু’ নামে একটি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়া কবি নজরুল লাঙ্গল, গণবাণী, পত্রিকাও প্রকাশ করেন। ধুমকেতু পত্রিকায় তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকার রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে গ্রেফতার করে তাঁকে।

সংগ্রামী জীবনের নানা সংকটময় মুহূর্তেও লোভ-লালসা কবিকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। তদুপরি তিনি দেশপ্রেমকে স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। এছাড়া অদম্য বাঙালি জাতির উপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে নবযুগে প্রকাশিত বাঙালির বাঙলা নিবন্ধে নজরুল লিখেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাঙলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করতে পারবে। বাংলার আবহাওয়ায় রয়েছে স্বাধীনতা মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি।’

নজরুল সাহিত্য, সাংবাদিকতার পাশাপাশি গানও রচনা করেছেন। তিনি আড়াই হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত ৩৬টি কবিতা ও সঙ্গীতের বই রয়েছে। অনুবাদ কাব্য প্রকাশিত হয়েছে তিনটি। ১৯৪২ সালে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন কবি। কলকাতায় অসুস্থ কবিকে ১৯৭২ সালে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন দেশে নিয়ে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্যবস্থা করেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশে তাঁর বসবাসের। এরপর তাঁকে প্রদান করা হয় একুশে পদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি।

কবি নজরুলের পুরো জীবনটাই ছিল বর্ণাঢ্য আর বৈচিত্রেভরা। সাহিত্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। শত দুঃখ ও দৈন্যতার মাঝেও তিনি হয়ে উঠেন চির উন্নত চির জাগ্রত বিবেকের প্রতিনিধি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরা শিশু আমরা সুন্দর
পরবর্তী নিবন্ধস্বামী অচ্যুতানন্দ পুরীর তিরোধান উৎসব