বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস ওয়েল আমদানি ও খালাসে নৈরাজ্য!

শর্ত থাকলেও মানা হচ্ছে না

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

দেশে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল আমদানি ও খালাসে একপ্রকার নৈরাজ্য চলছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সাথে চুক্তি করে ফার্নেস অয়েল আমদানি করলেও তারা শর্তগুলো মানছে না। শর্ত না মানলে আমদানি চুক্তি বাতিলের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপই নেয়নি বিপিসি। সর্বশেষ চুক্তির শর্ত প্রতিপালনের বিষয়ে গত মাসে বেসরকারি পাওয়ার প্লান্টগুলোকে চিঠিও দিয়েছে বিপিসি। এদিকে দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানেও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে বিপিসির শর্তগুলো না মানার প্রমাণ মিলেছে।
বিপিসির পরিচালক (অর্থ ও বিপণন) কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ফার্নেস অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির সাথে হওয়া চুক্তির শর্তগুলো মানছে না। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আবার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ফার্নেস অয়েল আমদানি তদারক করার জন্য একটি কমিটিও রয়েছে। এখন যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র শর্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
জানা যায়, দেশে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো শুরুতে পাওয়ার প্লান্টের ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিত। পরবর্তীতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বেসরকারি পাওয়ার প্লান্টগুলোকে প্রয়োজনীয় ফার্নেস অয়েল শর্তসাপেক্ষে আমদানির অনুমতি দেয়।
এতে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কম হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রায় সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে। কিন্তু শুরু থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির সাথে করা চুক্তির শর্তগুলো প্রতিপালন করছে না। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় বিপিসিও ঠিকমতো মনিটরিং করে না। এতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল আমদানি ও খালাসে একপ্রকার নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে।
বিপিসি সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়ে একটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমতি দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতিপত্রে কয়েকটি শর্তের মধ্যে উল্লেখ রয়েছে, আমদানিকৃত জ্বালানি তেলবাহী (ফার্নেস অয়েল) জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসার কমপক্ষে তিন দিন পূর্বে আবশ্যিকভাবে বিপিসিকে অবহিত করতে হবে। পরবর্তীতে জাহাজ বহির্নোঙরে আগমন কিংবা জেটিতে নোঙর (বার্থ) করলে বিপিসি বা এর প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি আমদানিকৃত বা আমদানিতব্য জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ পরিদর্শনপূর্বক নমুনা সংগ্রহ ও তার গুণগতমান ও পরিমাণ পরীক্ষা করতে পারবে। জ্বালানি তেল পরিবহনে ঝুঁকি এড়ানোতে ফার্নেস অয়েল পরিবাহী জাহাজের বয়সসীমা ২০ বছরের উর্ধে হওয়া যাবে না। আমদানিতব্য ফার্নেস অয়েল পরিবাহী জাহাজ ও লাইটার জাহাজ আবশ্যিকভাবে ‘ডাবল বটম, ডাবল হাল’ বিশিষ্ট হতে হবে। উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তাবলী ও সরকারি আইন-কানুন, বিধি বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করা না হলে বিপিসি এ চুক্তি বাতিল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য ফার্নেস অয়েল বিপিসির আওতাধীন তেল বিপণন কোম্পানি হতে ক্রয় করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রায় সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকপক্ষ প্রভাবশালী। তারা শর্ত প্রতিপালন না করলেও অনেকক্ষেত্রে প্রভাব দেখিয়ে চলেন। তারা বিপিসিকে গ্রাহ্যও করেন না। আমদানিতব্য ফার্নেস অয়েল বহির্নোঙরে আসার তিন আগে বিপিসিকে তথ্য দেয়ার কথা থাকলেও তারা তা মানছেন না। তারা অনুমোদনের বাইরে ফার্নেস অয়েল আমদানি করছেন না, সেটিরও নিশ্চয়তা নেই।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপিসির সাথে সম্পাদিত চুক্তির এসব শর্তের কোনটিই মানছে না বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল খালাসরত অবস্থায় দেখা যায়, জাহাজগুলোর সবকটিই ‘সিঙ্গেল হাল সিঙ্গেল বটম’ ক্যাটাগরির। আবার তিনটির বয়স ৪৫ বছরের উর্ধে। গতকাল রোববার দুপুরে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে কোলাগাঁও ইউনিয়নের বারাকা পাওয়ার প্লান্টে ফার্নেস অয়েল খালাস করছে এমটি সারিজা আলম নামের একটি ট্যাংকার জাহাজ। নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরে (এমএমডি) ২০০৭ সালে নিবন্ধিত হলেও এটি ‘সিঙ্গেল হাল সিঙ্গেল বটম’ ক্যাটাগরির জাহাজ। পাশের ইসিপিভি পাওয়ার প্লান্টে দুপুরে খালাসের জন্য বার্থিং করছিল ‘ওটি কিং ফিশার-১’ নামের লাইটার জাহাজটি। জাহাজটি নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনও নেয়নি বলে জানিয়েছেন দপ্তরের কর্মকর্তারা। এটিও ‘সিঙ্গেল হাল সিঙ্গেল বটম’ ক্যাটাগরির জাহাজ।
একইভাবে আনলিমা এনার্জি পাওয়ার প্লান্টে এইচএফও খালাস করছে এমটি ময়না নামের একটি জাহাজ। জাহাজটি এমএমডি থেকে ১৯৭২ সালে নিবন্ধিত। এতে জাহাজটির বর্তমান বয়স প্রায় ৪৯ বছর। এটিও ‘সিঙ্গেল হাল সিঙ্গেল বটম’ ক্যাটাগরির জাহাজ বলে জানিয়েছেন এমএমডি’র কর্মকর্তারা। অন্যদিকে জুলধা ইউনিয়নের কর্ণফুলী পাড়ে জুলধা-ওয়ান, জুলধা-টু, জুলধা-থ্রি নামের তিনটি পাওয়ার প্লান্টের মালিক প্রতিষ্ঠান একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিস লিমিটেড। কয়েকদিন আগে দেখা গেছে, পাওয়ার প্লান্টগুলোতে এমটি দেশ-১ এবং এমটি কোয়েল নামের দুটি জাহাজ ফার্নেস অয়েল খালাস করছে। এমএমডির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এমটি দেশ-১ জাহাজটি ১৯৭৬ সালে এমএমডি থেকে নিবন্ধিত। বর্তমানে জাহাজটির বয়স ৪৫ বছর। এটিও ‘সিঙ্গেল হাল সিঙ্গেল বটম’ ক্যাটাগরির জাহাজ। অন্যদিকে এমটি কোয়েল জাহাজটিও ১৯৭৫ সালে নিবন্ধিত। এটির বর্তমান বয়স ৪৬ বছর। এটিও ‘সিঙ্গেল হাল সিঙ্গেল বটম’ ক্যাটাগরির জাহাজ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি বিদ্যুৎ প্লান্ট মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ইমরান করিম রোববার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিজস্ব জাহাজ নেই। যাদের আছে তাদেরগুলো বিপিসির কমপ্লায়েন্স। যাদের নেই, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে জাহাজ ভাড়া করে এইচএফও (ফার্নেস অয়েল) পরিবহন করে থাকে। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিপিসি কমপ্লায়েন্স জাহাজ কিংবা ট্যাংকার আছে তাদের সাথেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চুক্তি করে থাকে। কিন্তু পরিবহনকালে কোন জাহাজ কোন ধরণের সেগুলো মনিটরিং করার সুযোগ কম থাকে। বিপিসির সাথে সম্পাদিত চুক্তির কোন অংশ মানতে ব্যত্যয় ঘটলে তা কিন্তু ইচ্ছেকৃত নয়। এগুলো অনিচ্ছাকৃত। তারপরও আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। বিপিসির শর্ত প্রতিপালন যাতে কোন সমস্যা না হয়, সেজন্য আমরা পদক্ষেপ নেবো।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপজেলা পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধির রায়ের বাস্তবায়ন চান উপজেলা চেয়ারম্যানগণ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬