বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশের ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার সকাল ৮টা থেকে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হয়ে তারা বিক্ষোভ করেন। এরপর বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে এসে দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। নতুন করে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের সমাগমের ঘটনায় পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়েছে। তবে ইমতিয়াজসহ আরো ৫ শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। এছাড়া বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে হিজবুত তাহরির ও ছাত্রশিবির স্বার্থ হাসিল করছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষার্থী। খবর বিডিনিউজের। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয় বুয়েট ক্যাম্পাসে। তবে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দপ্তর সম্পাদকসহ অনেকেই বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম এ সমাগম ঘটান।
এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। এরপর রাতে বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ফোরকান উদ্দিনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের (স্টুডেন্ট নং ২১০৪১৪১) হলের সিট বাতিল করা হয়।
গতকাল শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের সঙ্গে বুয়েটের বাকি যে সকল শিক্ষার্থী জড়িত ছিল তাদের একাংশের নাম–পরিচয় ও ছবি ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছি। ইমতিয়াজের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধানের নিয়ম ভঙ্গের দায়ে এবং বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অপশক্তি অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করায় তাদের সকলকে স্থায়ীভাবে একাডেমিক ও হল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি। এর বাইরে বাকি আরো যারা জড়িত, যাদের আমরা শনাক্ত করতে পারিনি, তাদের সকলকেই যেন বুয়েট প্রশাসন অনতিবিলম্বে শনাক্ত করে এবং উল্লিখিত অভিযুক্তদের মতোই একই মেয়াদে শাস্তির ব্যবস্থা করে।
অন্য দাবিগুলো হলো ১. শনিবার দুপুর ২টার মধ্যে লিখিতভাবে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমকে একাডেমিকভাবে স্থায়ী বহিষ্কার করা। ২. বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ক্যাম্পাসে প্রবেশের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বুয়েট প্রশাসনের লিখিত নোটিশ ও শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়ন করা। ৩. শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য রাত সাড়ে ১০টার পরে ছাত্রছাত্রীর ক্যাম্পাসে থাকা নিষেধ এবং যেকোনো প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের ওই সময়ের বেশি ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে গেলে ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের (ডিএসডব্লিউ) অনুমতির প্রয়োজন পড়ে।
ক) এক্ষেত্রে যদি বহিরাগতদের অনুমতি দেওয়া না হয়ে থাকে, তাহলে ডিএসডব্লিউর প্রটোকল ভেঙে তারা মধ্যরাতে সেমিনার রুমে মিটিং করেছে। এক্ষেত্রে ডিএসডব্লিউ নিজের প্রটোকল অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ। খ) আর যদি বহিরাগতদের অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে রেজিস্ট্রার অফিসের দেওয়া বুয়েটে সকল প্রকার রাজনৈতিক সংগঠন এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার লঙ্ঘন করেছেন ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান। গ) ক্যাম্পাসের অডিটোরিয়াম, সেমিনার রুম, ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন জায়গার ব্যবহার ডিএসডব্লিউ আওতাধীন। অনুমতি ছাড়া বহিরাগতদের এ জায়গাগুলো ব্যবহার করার মতো ধৃষ্টতামূলক আচরণ ডিএসডব্লিউর দায়িত্ব পালনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ছাত্রকল্যাণ দপ্তর পরিচালক মিজানুর রহমানের দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদত্যাগের দাবি করছে শিক্ষার্থীরা।
৪. ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে বহিরাগতদের প্রবেশে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এর প্রতিবাদে ৩০ ও ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনাল বর্জনসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছে শিক্ষার্থীরা। ৫. আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না–প্রশাসনের এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমরা সবসময়ই বুয়েটের সংবিধানে থাকা বুয়েটে সকল রকম ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ–এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংঘবদ্ধ এবং যেকোনো মূল্যে বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর। আমাদের এ সকল দাবি কেবল কোনো বিশেষ ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়; বরং আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুয়েটের সংবিধান অনুযায়ী সকল রকম ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছি।
নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব : উপাচার্য ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করার জন্য যা যা করার, করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। নিয়মবহির্ভূতভাবে একজনকে বহিষ্কার করলে সেটা আদালতে টিকবে না। নিয়মের মধ্যে সবকিছু করার জন্য সময়ের প্রয়োজন। যেহেতু রোজার মাস, সময় একটু বেশি দেওয়া উচিত ছিল।
গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন উপাচার্য। ওই ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, আজকে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর এর সদস্যদের মতামতও আমরা শুনব।
৩০ ও ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনাল বর্জনসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আমরা পরীক্ষা স্থগিত করিনি। তারা (শিক্ষার্থী) বর্জন করেছেন। তারা পরীক্ষা স্থগিতের আবেদনও করেননি। তারা আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করতাম। তারা এখানে ভুল করেছেন। পরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু তারা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী ঘণ্টা বাজবে, ছাত্ররা আসুক না আসুক। এমন ঘটনা বুয়েটে আগেও ঘটেছে। পরে তারা পরীক্ষার জন্য আবেদন করলে একাডেমিক কাউন্সিল বিবেচনা করতে পারে।
ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) অধ্যাপক মিজানুর রহমানের পদত্যাগের যে দাবি তুলেছেন শিক্ষার্থীরা, সেই প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ডিএসডব্লিউর পদত্যাগের বিষয়ে এখন আমরা চিন্তা করছি না। কারণ, এটা নরমাল একটা প্রসিডিউর। নিয়ম অনুযায়ী যখন হওয়ার হবে। ডিএসডব্লিউ বলেছেন, তার পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি ছিল না। শিক্ষার্থীরা দাবি করতেই পারেন। কিন্তু দাবির মুখে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। সময় হলে আমরা নতুন ডিএসডব্লিউ নিয়োগ দেব।
মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রবেশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে আমরা কারণ দর্শানোর নোটিস দেব যে, কেন তিনি ঢুকতে দিলেন। তার তো ঢুকতে দেওয়া উচিত হয়নি। গভীর রাতে কেউ (ক্যাম্পাসে) ঢুকলে এটা অবশ্যই অমানবিক বা অনিয়মতান্ত্রিক। কে ঢুকেছে, তাকে তো আগে চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত না করে তো শাস্তি দেওয়া যাবে না। তার জন্য সময় প্রয়োজন। যদি কোনো নিরাপত্তারক্ষী বহিরাগত ব্যক্তিদের ঢুকতে দিয়ে থাকেন, তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।
বুয়েটে হিজবুত তাহরির, ছাত্রশিবির স্বার্থ হাসিল করছে : বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে নিষিদ্ধ সংগঠন স্বার্থ হাসিল করছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষার্থী। গতকাল বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে তারা এই অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী তানভীর মাহমুদ স্বপ্নীল, আশিক আলম, সাগর বিশ্বাস, অরিত্র ঘোষ ও ২১ ব্যাচের অর্ঘ দাস উপস্থিত ছিলেন। আরও ২০–২৫ জন উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বুলিংয়ের ভয়ে তারা অংশ নেননি বলে এই শিক্ষার্থীরা দাবি করেন। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের বুলিংয়ের কিছু স্ক্রিনশট সাংবাদিকদের দেখান।
লিখিত বক্তব্যে ২০ ব্যাচের আশিক আলম বলেন, বুয়েটর সংবিধানে ক্যাম্পাসে সকল ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে আইন আছে, আমরা তাকে সম্মান করি। তবে এই সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে হিজবুত তাহরির, ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো কাজ করছে। আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনায় আমরাও দুঃখিত। তবে সে ঘটনার আবেগকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে।
আশিক বলেন, ২০২৩ সালে সুনামগঞ্জে বুয়েটের ৩৪ শিক্ষর্থীকে গ্রেপ্তার করা হলে আমরা মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করি। সে ঘটনায় আমাদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয় এবং ৭০–৮০ জন মিলে দুজনকে ডেকে কালচারাল র্যাগিং দেওয়া হয়। কারও পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত হলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও পরিবার নিয়ে অশালীন মন্তব্য করা হয়। তাদেরকে নিয়মিত র্যাগিং, বুলিং, হুমকি ও ভয় ভীতির মধ্যে জীবন কাটাতে হয়। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা চাওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে বুয়েট প্রশাসন ও সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলন।
লিখিত বক্তব্যে তানভীর মাহমুদ স্বপ্নীল বলেন, যে কারোর পারিবারিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত হলেই তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে থাকা হয়। এমনকি পরিবারকে নিয়েও অশালীন মন্তব্য করা হয় অনলাইন ও অফলাইনে।