বাসুদির অন্য মুখ

বিপুল বড়ুয়া | বুধবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

কব্জির ঘড়িতে টর্চের আলো ফেলে সময় দেখে নেয় সাইফুল। রাত সোয়া দু’টো। নদীর ডানপাশের এই উঁচু চর মতো জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। কাছে পাশে লোক বসতিও নেই। অপারেশনের সময় কোনো ঝামেলায়ও পড়া যাবে না। এই ভেবে সিরাজভাই ও সাইফুল কাল রেকি করার সময় এই জায়গাটিকে বেছে নিয়েছিলো। কুয়াশা চেপে বসেছে চারদিকে। আঘ্রাণের শেষাশেষি এই সময়টাকে শীতের আমেজ বেশ ভালোভাবে অনুভব করা যায়।
সবাই যার যার পজিশনে বসে গেছে। সিরাজ ভাই সবাইর সাথে শেষ মুহূর্তের টুকটাক কথা সেরে নিচ্ছেন। সাইফুলের সাথেও ছোটোখাটো পরামর্শ করে সামনে এগিয়ে যান সিরাজ ভাই। সিরাজ ভাইয়ের রংচটা ভারী খাকি জামা কুয়াশায় ভিজে সপ্‌সপ্‌ে। নিজের কাছে ফিরে আসে সাইফুল।
এক এক করে অনেক কথা মনে পড়ে সাইফুলের। যুদ্ধ শুরুর কথা, পালিয়ে সবার সাথে মামার বাড়ি যাওয়ার কথা, জাঁহাপুর হাই স্কুলের মাঠে ছিটেফোঁটা প্যারেড এর দৃশ্য, মামার সাথে আজাদীবাজারে বাজার সেরে বুক টিপটিপ করে বাড়ি ফেরা, হলদিয়া ক্যাম্পে-রামগড় ক্যাম্পে ছোটোখাটো ট্রেনিং সেরে আইয়ুব ভাইয়ের গ্রুপে যোগ দেয়া সব সব মনে পড়ে যায় সাইফুলের। মনে পড়ে যায় মা’র বিশীর্ণ মুখ, ছোটনের ভয়কাতুরে চাউনি, তিথির চুপসে যাওয়া।
এই চার মাসে বেশ ক’জায়গা ঘুরে তবে এই তারপাশা স্পটে আসা। হাইকমান্ডের নির্দেশে পাকবাহিনী রাজাকারের এদিকে ক্যাম্প করার সুবিধা নষ্ট করে দিতে তাদের আজকের এই অপারেশন।
চারপাশে ফিরে তাকায় সাইফুল। নাহ্‌ সবাই সতর্ক। সিরাজ ভাইকেও দেখা যাচ্ছে বামদিকে ঢিবি মতোন জায়গাটায়।
আবার অনেক কী ভাবনায় পড়ে যায় সাইফুল। এই মুহূর্তে চকিতে মনে পড়ে যায় বাসুদির কথা। শুধু এ মুহূর্ত নয় ক’দিন হতে কেনো যেনো বাসুদিকে মনে পড়ছে সাইফুলের। বাসুদি-বাসুদি। চৌদণ্ডি আটঘরের পরেই তো হরনাথপুর। নিত্যানন্দ ভগবতী হাই স্কুলের দক্ষিণে জেলা বোর্ডের বড় রাস্তার ওপাশেই তো বাসুদিদের বাড়ি।
বাসুদির ছোটভাই বরুণের সাথে তার কী না ভাব! একসাথে খেলতো, পড়তো। পয়-পার্বণে এখানে ওখানে সেই কাশীপুরের মেলায় কী না হৈ চৈ করে বেড়াতো। তাদের দুজনের এ বাড়ি ও বাড়ি কী না আসা যাওয়া ছিলো।
যুদ্ধ শুরুর আগে গণ আন্দোলনের উত্তাল সেই সময়ে বরুণদের বাড়িতে। সেই-ই প্রথম বাসুদিকে দেখা। ঢাকায় কোন বড় কলেজে পড়ে। চারদিকে থম্‌থম্‌ে অবস্থা দেখে বাড়ি এসে গেছে।
তারপর যত দিন গড়িয়েছে বাসুদিকে তত কাছে থেকে দেখার চেনার সুযোগ হয়েছে সাইফুলের। আস্তে আস্তে তাদের খেলার সঙ্গীও হয়ে গেলো বাসুদি। এক সাথে বাগানে ফুল কুড়োতো, ঢাকার গল্প করতো, তাদের বাড়ির খবরাখবর নিতো। ভারি সুন্দর গানের গলা ছিলো বাসুদির। ধরে বসলেই অমনি গুনগুন করে গাইতো। চোখের পাতা আবেশে বুজে আসতো সাইফুলের। ওদিকে গেলে কাঁসার বাটি করে দুধ, ক্ষীর আরো কী কী খেতে দিতো। বাড়ির সবার জন্যও এটা ওটা কি সব পাঠিয়েও দিতো। তার আনার লজ্জা দেখে সে কী রাগ দেখাতো। এতসব দেখে সাইফুলের মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে হতো বাসুদি, তুমি এতো কেন ভালো। তোমার হৃদয়ে কতো সুখ জমা বাসুদি। কিন্তু সেই সুখের দিনগুলি কোথায় যেন দ্রুত হারিয়ে গেল।
শুরু হলো পাকিস্তানি-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ। চারদিকে শুধু পালা আর পালা। কেউ শহর ছেড়ে গ্রামে কেউ গ্রাম ছেড়ে সীমান্তের দিকে। একটা অস্থির সময়ে এসে যেন দাঁড়িয়ে গেল দেশ কাল। সবাইকে কোথায়ও না কোথাও যেতে হবে। কিছু না কিছু একটা করতে হবে। অস্থিরতা-দুর্ভাবনায় পড়ে বেশ ক’দিন বাসুদিদের ওদিকে যাওয়া হলো না সাইফুলের।
সেই ফাঁকে বরুণ একদিন সোনাতলা হাট হতে ডেকে নিয়ে গেল সাইফুলকে। বাসুদি যেতে বলেছে। সাইফুল গিয়ে দেখে তাদের বাধাছাঁদা শেষ।
বাসুদি বললো তারা আজ মাঝরাতে সীমান্তের দিকে রওনা দেবে। বাবা কাকারা বলছে গ্রামে থাকা নিরাপদ নয়। যে কোনো সময় মিলিটারি আসতে পারে। আনুহাটের গোলজার চেয়ারম্যান রাজাকার ট্রেনিং দিয়েছে তারাও হামলা করতে পারে। তাই তারা আগেভাগে চলে যাচ্ছে।
চালতাতলার ওদিকে বাসুদির সাথে দেখা সাইফুলের। গাছটার ডান দিকে ঝুঁকে পড়া ডালে ক্লিপ দিয়ে আনমনে ছাল খুঁটছে। চেয়ে আছে দূরের দিকে। তাদের পদশব্দে ত্রস্তে ফিরে থাকায় বাসুদি। চোখে মুখে অদ্ভুত বিশীর্ণ নির্লিপ্ততা। বিষণ্নতাও যে কতো অর্থময় হতে পারে তা সাইফুলের আগে কখনো জানা ছিলো না। একটি দীর্ঘশ্বাস সাইফুলের বুক চৌচির করে বেরিয়ে আসে।
হাসলো বাসুদি সাইফুলের অপ্রস্তুততা দেখে। তাদের নিয়ে পিছনের শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে বসে এ কথা সে কথা বলতে বলতে এক সময় বলে ফেলে বাসুদি-যাই সাইফুল। কে জানে কখন আবার দেখা হবে, অথবা আদৌ হবে কি না? তবে তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে মনে পড়বে।’
“আচ্ছা সাইফুল যুদ্ধ কবে শেষ হবে জানো?’ হঠাৎ বাসুদির কাছ হতে এ ধরনের ভিন্নতর প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সাইফুল। মনে হলো বাসুদিও যেন তার মতো ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। কিছুই বলা হলো না সাইফুলের। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে বাসুদির দিকে। ভাবলো শুধু ভাবলো-এ কোন বাসুদি।
রোদ ক্রমশ ঝিম ধরে কমতে থাকে। অথচ বাসুদি আরও শব্দমুখর হয়। ‘সাইফুল, তুমি কি করবে? তুমিও যুদ্ধে যাবে না? হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না?’
একটি দীর্ঘ, ব্যঞ্জনাময় প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দেয় বাসুদি সাইফুলকে। কী বলবে সাইফুল বাসুদিকে-ভেবে পায় না। একটি সুযোগের অপেক্ষায় কোথায় যেন পালিয়ে যেতে যেতে সেই ভরসন্ধ্যায় সাইফুল হারিয়ে ফেলে তার বড়ো চেনা কাছের বাসুদিকে। বাসুদির কাছে হেরে যাওয়া সাইফুলের সেই শেষ দেখা।

তারপর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সাইফুল। মুখচোরা, লাজুক-স্বভাবের, ছিমছাম সাইফুল হয়ে উঠে দায়িত্বশীল, সদাসতর্ক, কর্তব্যকঠোর হানাদার হননকারী মুক্তিযোদ্ধা। কোথায় যেন হারিয়ে যায় তার অতি সামপ্রতিক জীবনযাপন পরিচিত মুখ। একে একে হারিয়ে যায় তাদের চুপচাপ নিস্তব্ধ গাঁ, হরিহর কাকা, কাকিমা, বাসুদি, ছায়াসঙ্গী বরুণ, পৌষের মেলার হৈ-চৈ, নিত্যানন্দ ভগবতী হাই স্কুলের মনমাতানো ঘণ্টাধ্বনি। সব-সব হারিয়ে ফেলে সাইফুল। হারিয়ে ফেলে কবেকার আটপৌরে সাইফুলকে।
দুটি একটা নিশাচর পাখি যেনো ডেকে গেল। তন্ময়তা ভাঙে সাইফুলের। লোডেড স্টেনের ম্যাগজিনের গায়ে জমে উঠা শিশিরকণা গলার ভারী মাফলার দিয়ে মুছে নড়ে চড়ে বসে সাইফুল। চারদিকে দেখে নেয় সাইফুল। নাহ্‌ সবাই সদা সতর্ক জেগে আছে। কাল ক্যাম্পে খবর এসেছে এই নদীপথেই আজ ভোর রাতের মধ্যে পাক সেনারা তারপাশার দিকে এগোবে। তাদেরকে যে করে হোক রুখতে হবে হটিয়ে দিতে হবে। দয়াগঞ্জের ওদিকের মুক্তাঞ্চলের যেন পাকবাহিনী কোনোভাবে দখল নিতে না পারে। একটা বড় অপারেশনের ভালো কাজ করার পর সিরাজ ভাই তাকেই নদীর পশ্চিম দিকটা দেখার দায়িত্ব দিলো। নিজের ওপর কমান্ডের আস্থা দেখে গর্বে বুক ফুলে ওঠে সাইফুলের।
গাঢ় কুয়াশার মধ্যেও চোখ, কান খোলা রেখে হালদার আল-জোয়ারের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে সাইফুল। আশ্চর্য এই বিপদসংকুল মুহূর্তেও কেমন যেনো নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে সাইফুলকে। হায় এমন যোদ্ধা যোদ্ধা বেশে, স্টেন হাতে, মুচড়ানো ক্যাপ মাথায় বাসুদি তাকে যদি দেখতে পেতো, কি ভাবতো? কি বোঝতো? তবে সাইফুল ভাবে-অন্য কিছু ভাবুক বা না জানুক অন্তত একটা প্রশ্নের উত্তর জেনে যেতো বাসুদি এক বিষণ্ন বিকেলে বাসুদির যে প্রশ্নের উত্তর সাইফুলের দেয়া হয় নি-বাসুদি আমি যুদ্ধে গেছি। আমার হাতে এখন অস্ত্র। বাসুদি আমরা আবার আমাদের পুরনো পৃথিবীতে ফিরে যাবো। সেই চালতাতলায়, শানবাঁধানো পিছন পুকুর ঘাটে, আনন্দের হাট বসাবো। বাসুদি আমরা কোনোদিন হারবো না। কোনদিনও না।
এতসব ভাবতে ভাবতে এই মুহূর্তে সাইফুলের ভারি মনে পড়ে যায় বাসুদিকে, বরুণকে। ওরা এখন কোথায় আছে। দেশে যে নেই তা সাইফুল নিশ্চিত। তাদের সাথে আবার দেখা হবে কি? যুদ্ধ কখন থামবে? কখন দেশ স্বাধীন হবে? তারা সবাই ঘরে ফিরে যাবে? বাসুদিকে কখন সে যুদ্ধের গল্প, যুদ্ধ জয়ের গল্প শোনাবে?
চকিতে ক’টি জল হরিয়ালের তীক্ষ্ম শিস্‌ ভেসে আসে পশ্চিম দিক হতে। জল-খালের মানুষরা বলে ওরা ব্যতিক্রমী কোনো কিছুর আগাম জানান দেয়। সাইফুল আরও নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। বাম হাতের টর্চটা বার দুই জ্বলা নেভা করে সিরাজ ভাইদের সাথে সিগন্যাল বদলিয়ে নেয় সাইফুল। পিছনের বাম পাশের ওরাও সাড়া দেয়।
সাইফুল ক্রল করে আরও ক’গজ ডানদিকে সরে সামনের নদীবাঁকের কৌণিক দূরত্বটা আরো ছোট করে স্টেনের রেঞ্জের সাথে এডজাস্ট করে নিশ্চিন্ত মনে সাইডবারে হাত রাখে। ফায়ারিং এর অপেক্ষা শুধু।
চারদিকে অবাক করা নিস্তব্ধতা। ঝিমধরা রাত্রির আকাশেও যেনো যুদ্ধ যুদ্ধ মুহূর্ত। সাইফুলের কেমন জানি ভারি ভালো লাগে। সাইফুলের এই মুহূর্তে শুধু মনে পড়ে বাসুদির সেই কথাকে। সেই বিষণ্ন বিকেল সন্ধ্যাকে।
একটি ইঞ্জিন বোটের জল কেটে এগিয়ে আসার মৃদু শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ছুরি কাটা করে। সাইফুলকে সতর্ক করে তোলে। মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল কঠোর কঠোরতম নিজকে ক্রমশ বলিষ্ঠভাবে ফিরে পায়। ফায়ারিং ওপেন করার পূর্ব মুহূর্তে কি এক দ্যোতনায় সাইফুলের শিরদাঁড়া টান টান করে উঠে। অতপর সাইফুলের চোখের পাতায় একে একে ভেসে ওঠে স্বাধীনতা, যুদ্ধ জয়ের গল্প ও বাসুদির অন্য মুখ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেমিকাকে বিয়ে করায় আজহারের পরিকল্পনায় খুন হন ইব্রাহিম
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে রান্না ঘরের চুলার আগুনে পুড়ল ৬ বসতঘর