বিয়ে দেয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় একমাত্র মেয়ে সুপ্তি মল্লিকের লাশ কাঁধে নিতে হলো অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাধন কুমার মল্লিককে। পুলিশের ধারণা, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তারা প্রাথমিক কিছু আলামতও সংগ্রহ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্বামী বাসুদেব চৌধুরী ও ভাসুর অনুপম চৌধুরীকে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সুপ্তির পরিবারের সন্দেহের তীরও এই দুজনের দিকে। ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ আজাদীকে বলেন, খবর পেয়ে আমরা লাশ উদ্ধার করেছি। উনার লাশ খাটে শুয়ানো ছিল। সুপ্তির বাবা সাধন কুমার মল্লিক মামলায় তাঁর মেয়ের জামাই ও ভাসুরকে আসামি করেছেন। আমরা বাদীর অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে দেখছি। পাশাপাশি সম্ভাব্য অন্যান্য কারণও খতিয়ে দেখছি। অন্য কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে ওসি বলেন, আমরা একটু নিশ্চিত হলে আপনাদের জানাব।
নগরীর ডবলমুরিং থানার পানওয়ালা পাড়ার নাসিমা মঞ্জিলের চতুর্থ তলার একটি বাসা থেকে গত ৪ নভেম্বর রাত ১২ টার দিকে সুপ্তির (২২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সুপ্তি মল্লিক রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা কেপিআই এলাকার সাধন কুমার মল্লিকের মেয়ে। থানা পুলিশের পাশাপাশি সিআইডির ক্রাইম ইউনিটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছে। কেন কি কারণে কিভাবে সুপ্তি মল্লিকের মৃত্যু হলো, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। স্বামীসহ সুপ্তি যে ভবনে থাকতেন সেই চারতলা বিশিষ্ট নাসিমা মঞ্জিলে গতকাল ৫ নভেম্বর দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই ভবনে ৬০টি পরিবার বাস করে। সুপ্তি ও তার স্বামী বাসুদেব থাকতেন ৫৩ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন। ওই ফ্ল্যাটে প্রথম থেকে থাকতেন সুপ্তির ভাসুর অনুপম চৌধুরীর পরিবার। পরে সেখানে স্ত্রী সুপ্তিকে নিয়ে ওঠেন স্বামী বাসুদেব চৌধুরী।
সুপ্তির প্রতিবেশী ফাতেমা পারভীন রিয়া জানান, ঘটনার দিন অর্থাৎ বুধবার বেলা তিনটার দিকে সুপ্তি আমাদের বাসার দরোজায় আসেন। আমি ভেতরে ও সুপ্তি দরোজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এসময় এক ব্যক্তিকে সুপ্তিদের ঘরে আসতে দেখি, বয়স আনুমানিক ৩০/৩২ বছর হবে। কে জানতে চাইলে সুপ্তি বলেন, ‘উনি আমার ‘আংকেল’ হন। ১২টার দিকে জানিয়েছিলেন ভাত খেতে আসবেন। এখন এসেছেন।’ এসময় সুপ্তি আমাকে অনুরোধ করে দুই কাপ চা করে পাঠাতে। আমার মেয়ে চা বানিয়ে দিলে তাকে ডেকে দুই কাপ চা দেই। বিকেল পাঁচটার দিকে হঠাৎ মনে হলো সুপ্তিদের বাসাটা কেমন জানি নিরব, কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাইরে এসে দেখি দরজার সামনে পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দা উল্টে দেখি দরজা বাইরে থেকে আটকানো আছে। একটু খটকা লাগলো। বার কয়েক সুপ্তির নাম ধরে ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। পাশের বাসার ভাবীকে ডেকে বিষয়টি জানালাম। তিনি দরোজার ফুটো দিয়ে ভেতরে দেখে সুপ্তির স্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। স্যান্ডেল ভেতরে থাকলে দরজা বাইরে থেকে আটকাল কে? হঠাৎ মনে পড়ল সুপ্তির ‘আংকেল’ ডাকা সেই লোকটির কথা। আমরা ফোন করে ভবনের ইনচার্জ আজিজ সাহেবকে বিষয়টি জানাই। এরপর ভবনের দারোয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াছ আসেন।
দারোয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, মাগরিবের নামাজ পড়তে আমি তখন মসজিদে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আজিজ সাহেব আমাকে বিষয়টি জানালে আমি ছুটে যাই। দেখি সেখানে ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের মহিলারা ভিড় করেছেন। আমাকে দেখে ৫০ নম্বর ফ্ল্যাটের মহিলা ফাতেমা বিষয়টি জানান। পরে তিনি ও অপর একজন মহিলা দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে দেখেন পেছনের বেডরুমে সুপ্তি চিৎ হয়ে শুইয়ে আছেন। মহিলারা গায়ে হাত দিয়ে দেখেন তার দেহ নিথর।
সুপ্তির ছোট ভাই প্রসেনজিৎ মল্লিক জানান, বিয়ের ১০ দিনের মাথায় সুপ্তি জানতে পারেন, বাসুদেবের সাথে তার বড় ভাই অনুপমের শালীর সম্পর্ক ছিল। সুপ্তির সাথে কারও সম্পর্ক ছিল কিনা জানতে চাইলে প্রসেনজিৎ বলেন, আমার বোন রাঙামাটি কলেজে পড়ার সময় এক মুসলিম যুবকের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেই সম্পর্ক দুই থেকে আড়াই বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। তবু বিষয়টি বিয়ের আগে বাসুদেবকে জানানো হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এতে তার কোনো আপত্তি নেই।
সুপ্তির বাবা সাধন কুমার মল্লিক জানান, তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে সুপ্তি বড়। গত ১৩ আগস্ট সুপ্তির সাথে পটিয়ার বাসুদেব চৌধুরীর বিয়ে দিই। বাসুদেব জামালখানে একটি ওষুধের দোকানে চাকরি করে। বিয়ের পর সুপ্তিকে সে পটিয়ায় গ্রমের বাড়িতে নিয়ে যায়। বিয়ের ১০ দিন পর আমার মেয়ে জানতে পারে বাসুদেবের সাথে আরো কয়েকটা মেয়ের পরকিয়ার সম্পর্ক আছে। সুপ্তি এর প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্ন সময় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো। আমার মেয়ে বিষয়টি আমাকে জানলে আমি তাকে ধৈর্য ধরতে বলি। আমার মনে হয়েছিল সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের দশ দিন পর সুপ্তিকে তার স্বামী পানওয়ালাপাড়া নাসিমা মঞ্জিলের ৫৩নং ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে বাসুদেবের বড় ভাই অনুপম চৌধুরী থাকতেন। এখানে নিয়ে আসার পর সুপ্তির ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বাসুদেবের পাশাপাশি তার বড় ভাই অনুপমও আমার মেয়ের উপর নির্যাতন করতে থাকেন। মেয়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার মাকে ফোন করে বিষয়গুলো জানাতো আর মা মেয়ে কান্না করত। গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাসুদেব আমার স্ত্রীকে ফোন করে জানায়, সুপ্তির সাথে তার বিকেল চারটার দিকে কথা হয়েছিল, এর পরে আর সে ফোন ধরছে না। আপনারা কেউ একজন পানওয়ালা পাড়ার বাসায় আসেন। এ কথা বলেই ফোন কেটে দেয় বাসুদেব। আমার স্ত্রী ও ছেলে রাত আটটার দিকে পানওয়ালাপাড়ার বাসায় এসে খাটের উপর মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পায়। খবর পেয়ে আমিও আসি। আমরা থাকাবস্থায় পুলিশ আসে। এখন ভাবছি, প্রথম যেদিন মেয়ে নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়েছিল, তখন গুরুত্ব দিলে আজ মেয়েকে হারাতে হতো না। তিনি বলেন, প্রতিবেশীদের কাছে যা শুনেছি, তাতে আমি নিশ্চিত যে বাসুদেব ও তার ভাই অনুপম মিলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তৃতীয় কাউকে দিয়ে আমার মেয়েকে খুন করিয়েছে।