বার্থিং নিয়ে দুই জাহাজের ‘যুদ্ধ’

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ এবার চট্টগ্রামে! গত কয়েকমাস ধরে টানা চলে আসা যুদ্ধের জেরে না হলেও দেশ দুইটি থেকে গম নিয়ে আসা জাহাজ দুইটির বার্থিং নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ চলে চট্টগ্রামে। অঘোষিত এই যুদ্ধে প্রভাব প্রতিপত্তিতে রাশিয়া জয়লাভ করে নিজের জাহাজ বার্থিং দিতে সক্ষম হয়েছে। সরকারের জন্য গম নিয়ে আসা জাহাজ দুইটির অঘোষিত এই যুদ্ধ চট্টগ্রামের শিপিং সেক্টর এবং খাদ্য বিভাগে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারের খাদ্য বিভাগের জন্য গম নিয়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে দুইটি মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এরমধ্যে ইউক্রেন থেকে আসা এমভি ম্যাগনাম ফরচুন জাহাজটি গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের কর্নোমক্স বন্দর থেকে গম নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। জাহাজটিকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে চট্টগ্রামে আনা হয়। পথিমধ্যে তুরস্কে এক মাসেরও বেশি সময় সিকিউরিটিসহ নানা আনুষ্ঠানিকতার জন্য জাহাজটিকে আটকে থাকতে হয়। শুরু থেকে দেড় মাসেরও বেশি সময়ের যাত্রা শেষ করে ইউক্রেনের ৫১ হাজার ১৭৫ টন গম নিয়ে গত ৯ নভেম্বর জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। অপরদিকে রাশিয়ার নভোরসিক্স বন্দর থেকে ৪৯ হাজার ৪শ টন গম নিয়ে এমভি ভেরুদা নামের জাহাজটি গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পথ ধরে। এই জাহাজটিও একই দিন গত ৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। এরপর থেকে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের গম নিয়ে আসা দুই জাহাজের বার্থিং নেয়া এবং পণ্য খালাসের অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই ধরনের বড় একটি জাহাজ একদিন আগেও পণ্য খালাস করে রিলিজ নিতে পারলে কমপক্ষে ৩০ হাজার ডলার সাশ্রয় হয়। জাহাজ দুইটি বহির্নোঙরে অবস্থান করে দ্রুত গম লাইটারিং এবং ড্রাফট কমিয়ে গ্রেন সাইলো জেটিতে বার্থিং নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। এরমধ্যে ইউক্রেনের গম নিয়ে আসা এমভি ম্যাগনাম ফরচুন ১০টি লাইটারেজ জাহাজে ২১ হাজার ৪১৫ টন গম লাইটারিং করে নিজের ড্রাফট ১১.০৮ থেকে কমিয়ে গ্রেন সাইলো জেটিতে বার্থিং নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় ১৫ নভেম্বর রাতে। এমভি ম্যাগনাম ফরচুন জাহাজে থাকা ২৯ হাজার ৭৬০ টন গমের পুরোটাই চট্টগ্রাম গ্রেন সাইলোতে খালাস করার কথা। কিন্তু বার্থিং এর জন্য লাইনে থাকা রাশিয়া থেকে ৪৯ হাজার ৪শ টন গম নিয়ে আসা এমভি ভেরুদা জাহাজটি ১২টি লাইটারেজ জাহাজে ১৯ হাজার ১শ টন গম খালাস করে ড্রাফট ১১.৪৫ মিটার থেকে কমিয়ে অনুমোদিত ড্রাফটে নিয়ে আসে। এই জাহাজটি চট্টগ্রাম গ্রেন সাইলোতে ১০ হাজার
৫৪০ টন গম খালাস করে বাকি ১৯ হাজার ৭৬০ টন গম নিয়ে মংলা বন্দরে যাওয়ার কথা রয়েছে। এই জাহাজটিও গ্রেন সাইলো জেটিতে আসার জন্য তৈরি হয় গতকাল সকালে।
জাহাজ দুইটি শুরু থেকে কার আগে কে পণ্য খালাস করার সুযোগ পাবে তা নিয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকে। তবে আগে প্রস্তুতির ঘোষণা দেয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ইউক্রেন থেকে আসা এমভি ম্যাগনাম ফরচুন জাহাজকে সাইলোতে আনার পাইলট প্রেরণ করে। জাহাজটিকে পাইলট গ্রাউন্ডেও নিয়ে আসা হয়। কিন্তু গতকাল বিকেলে সাইলো থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট এমভি ম্যাগনাম ফরচুনের পরিবর্তে এমভি ভেরুদাকে বার্থিং দেয়ার জন্য পত্র দেয়। পত্রটিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। দুইটি জাহাজই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গম নিয়ে এসেছে। দুইটি জাহাজই একই সাইলোতে গম খালাস করবে। এরপরও একটিকে বন্ধ করে অপরটিকে বার্থিং দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কেন নির্দেশনা দেয়া হলো তা নিয়েও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদেরকে সাইলো সুপার মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ খান শিবলী চিঠি দিয়েছেন। উনারা আমদানিকারক। উনাদের চাওয়ার তো একটি মূল্য দিতেই হবে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কথা চিঠিটিতে উল্লেখ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি চিঠির একটি কপি দৈনিক আজাদীকে প্রদান করেন।
এ ব্যাপারে ইউক্রেনের গমবাহী জাহাজ এমভি ম্যাগনাম ফরচুনের স্থানীয় এজেন্ট সেভেন সিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলী আকবর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে আজাদীকে বলেন, কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনেকটা ক্ষমতার জোর দেখিয়ে জাহাজটিকে বার্থিং দেয়া হয়েছে। আমাদের জাহাজ আগে প্রস্তুত করেছি। আমরা ঘোষণাও দিয়েছি। বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সাইলো কর্তৃপক্ষ আমাদের জাহাজ ভিড়ানোর যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের জাহাজের বার্থিং বন্ধ করে ওই জাহাজটিকে বার্থিং দেয়া হয়েছে। একটি জাহাজ বার্থিং দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির ব্যাপারটিতে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি মাথায় আসছে না যে একই গুদামে একই পণ্য খালাস করা হবে। এতে আগে পরে লাভ লোকসান হবে জাহাজের, মন্ত্রণালয় বা সরকারের নয়। তাহলে মন্ত্রণালয় কেন একটি জাহাজের বার্থিং ঠেকাতে চিঠি দিয়ে পক্ষ নিল তা রহস্যজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, একই ধরনের পণ্য নিয়ে আসা দুইটি জাহাজের মধ্যে একটির পক্ষ নিয়ে চিঠি ইস্যুর ব্যাপারটি নজিরবিহীন।
বিষয়টি নিয়ে রাশিয়া থেকে আসা গমবাহী জাহাজ এমভি ভেরুদার স্থানীয় এজেন্ট রেনু শিপিং লাইন্সের স্বত্ত্বাধিকারী পরেশ চন্দ্র দাশের সাথে যোগাযোগের জন্য দফায় দফায় ফোন করেও পাওয়া যায়নি। কোম্পানির ম্যানেজার অঞ্জন দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রেনু শিপিং লাইন্সের একটি রিপোটেশন আছে। আমরা কোনো ধরনের অনিয়ম করি না। এই জাহাজটির ব্যাপারেও আমরা কোনো অনিয়ম করিনি। বন্দর কোনো অনিয়ম করেনি। আমরা বহির্নোঙরে লাইটারিং করে ড্রাফট কমিয়েছি। সাইলোতে এসে বাকি গম খালাস করে আমাদের জাহাজ চলে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের মালিকের কথা হচ্ছে কোনো অনিয়ম করা যাবে না। কোনো অনিয়ম আমরা করিনি। আমাদের বিরুদ্ধে কারা এসব ফেইক নিউজ দেয় তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি
পরবর্তী নিবন্ধহুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা