প্রাকৃতিক বন-জঙ্গলের পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে দেশীয় প্রজাতির বানরের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। কোলের সন্তান-সন্ততি নিয়ে পুরো পার্কজুড়ে এ সব বানরের আধিপত্য। তন্মধ্যে মাত্র ৭৯টি বানরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রেশনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেই রেশনের খাবার দিয়ে এ সব বানরের ক্ষুধা নিবারণ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে। অবশ্য অন্যান্য উন্মুক্ত প্রাণীর খাবারে ভাগ বসায় এ সব বানর। আবার পার্কে আগত পর্যটক-দর্শনার্থীর হাতের কাছে কোনো খাবার দেখলেই সেই খাবার বানরদের কেড়ে নিতে দেখা যায় প্রতিনিয়ত। এতে দর্শনার্থীরাও বেশ আনন্দ পায়। পার্কটিতে এ ভাবেই চলছে বানরের জীবনযাপন।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৯৯ সালে ৬০০ হেক্টর প্রাকৃতিক বনে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এই সাফারি পার্ক। পরবর্তীতে আরো ৩০০ হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয় পার্কের পরিধি। বর্তমানে পার্কে ২২৬টি বন্যপ্রাণী ও পশু-পাখি রয়েছে। তন্মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা ৭৯টি, সরিসৃপ প্রজাতির প্রাণী ৬৮টি এবং পাখি প্রজাতির প্রাণী রয়েছে ৭৯টি। অপরদিকে স্তন্যপায়ী ১৪ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের দুটি করে ৪টি বাঘ, ৩টি সিংহ (রাসেল-টুম্পা ও তাদের সন্তান সম্রাট), ১৮টি এশিয়াটিক কালো ভল্লুক, ১০টি জলহস্তি (ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত) ৬টি আফ্রিকান ওয়াইল্ডবিস্ট, ৬টি পোষা হাতি (একটির নাম রংমালা, যার বয়স ৮০ বছর), ১০টি গয়াল, আবদ্ধ অবস্থায় ৮টি চিত্রা হরিণ, ৩টি মায়া হরিণ। এ ছাড়াও উন্মুক্ত অবস্থায় দুই প্রজাতির প্রায় ৩০০ হরিণ নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে বিচরণ করছে। অপরদিকে ৫টি আফ্রিকান জেব্রা, একটি বয়ষ্ক আসামী বানর অন্যতম।
পার্কে ২০ প্রজাতির পাখি রয়েছে ৭৯টি। সবগুলোই খাঁচায় বন্দি। তন্মধ্যে বিদেশী প্রজাতির পাখি রয়েছে ইমু, ময়ূঁর, আফ্রিকান গ্রে প্যারট, রোজেলা, পেলিকন ইত্যাদি। বাকীগুলো দেশীয় প্রজাতির বিরল পাখি। আর আবদ্ধ অবস্থায় সরিসৃপ প্রাণী রয়েছে ৯ প্রজাতির। তন্মধ্যে মিঠা ও লোনা পানির কুমির রয়েছে ১৭টি, ৫টি অজগর, তিন প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে ১৭টি টার্টেল, ১৯টি টাট্টুইস ও ১১টি কড়িকাইট্টা। সরজমিন পার্কের বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বেষ্টনি ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁফিয়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীগুলো। বিশেষ করে বাঘ এবং সিংহগুলো বেষ্টনির ভেতরের উন্মুক্ত এলাকা ছেড়ে পাকা ঘরের মধ্যেই শুয়ে রয়েছে। পার্কে থাকা প্রাণীগুলোর খাবারের রেশনিং ঠিকমতো চলমান রয়েছে কী-না জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পার্কের বন্যপ্রাণী ও পশু-পাখির জন্য সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত খাবার নিয়মিতই দেওয়া হয়ে থাকে। প্রাণীদের খাবার নিয়ে এখানে কেলেঙ্কারির কোনো সুযোগই নেই। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক পার্কের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকে। মূলত প্রাণীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ডাক্তারি পরামর্শে ওইদিন প্রাণীদের খাবার দেওয়া হয় না। তাই বরাদ্দও রাখা হয়নি।’ কোন প্রাণীর জন্য কী পরিমাণ খাবার বরাদ্দ রয়েছে- এর প্রত্যুত্তরে পার্ক কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম জানান, বাঘ ও সিংহের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৬দিন এক বেলায় ৬ কেজি করে গরুর মাংস খেতে দেওয়া হয়। পার্কের বন্যপ্রাণী ও পশু-পাখির জন্য খাবার সরবরাহের জন্য নিয়োজিত ঠিকাদার সরাসরি পার্কেই নিয়ে আসেন গরু। এ সময় কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতেই গরু জবাইয়ের পর বাঘ-সিংহের বেষ্টনিতে মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য প্রাণীর বেষ্টনিতেও পৌঁছে যায় তাদের খাবার।
নরসিংদী থেকে পরিবার নিয়ে আসা গোপাল সাহা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পার্কে বাঘ, সিংহ, ওয়াইল্ডবিস্ট, জলহস্তিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। এতে আমরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি।’
নড়াইল থেকে পার্ক ভ্রমণে আসা উম্মে কুলসুম দম্পতি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পুরো পার্কজুড়ে বানরের রাজত্ব দেখে বেশ ভালই লাগছিল।’ সরজমিন পরিদর্শনকালে আরো বেশ কয়েকজন পর্যটক-দর্শনার্থী বলেন, এই পার্ক দিন দিন বেশ উন্নত হচ্ছে। আগামীতে পর্যটক-দর্শনার্থীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তারা।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক এবং চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পুরো পার্ককে সঠিক ব্যবস্থাপনাতেই পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে বন্যপ্রাণী ও পশু-পাখিগুলোর খাবার নিয়ে নয়-ছয় করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ খাবার সরবরাহের সময় কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা প্রতিটি প্রাণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রাদিসহ যথাযথভাবে পরিচর্যা করেন। এতে সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে চলছে। তবে পার্কে বানরের সংখ্যা খুবই বেশি। তাই সব বানরের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার বিষয়টি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা হবে।’