প্রচলিত নিয়ম না মেনে টেন্ডার আহ্বান ছাড়া শুধুমাত্র বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে ইনকনট্রেড লিমিটেডকে দেয়া চট্টগ্রাম বন্দরের ৪শ কোটি টাকা মূল্যের ৮ একর ভূমির ইজারা অবশেষে বাতিল করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে গোপনে ওই ভূমি ইজারা দেওয়ার অভিযোগ উঠলে চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আজাদী গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধান খবর হিসেবে ঘটনাটি প্রকাশ করে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন ১৩ ও ১৪ নম্বর খালের মধ্যবর্তী ২২.৭৭৬ একর ভূমি ২০০৫ সালের ১৩ জুলাই ইনকনট্রেড লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট ৩০ বছরের জন্য ইজারা প্রদান করা হয়। ওই চুক্তিতে ইজারার মেয়াদ পরবর্তীতে আরো ২০ বছর বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়। উক্ত ভূমিতে ইনকনট্রেড লিমিটেড আইসিডি নির্মাণ করে। ব্যবসা সমপ্রসারণ করার জন্য ইনকনট্রেড গত ২ জানুয়ারি তাদের অনুকূলে আরো ৮ একর ভূমি ইজারা প্রদানের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইনকনট্রেডের আবেদন দ্রুত বিবেচনা করে ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার ৬ নম্বর খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত বিএস দাগ নম্বর ১১৫ (অংশ) এবং ১২৪ (অংশ) দাগাদীর আন্দর ৮ একর ভূমি ইজারা প্রদান করে। শুধুমাত্র বোর্ড সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে বন্দরের বিপুল পরিমাণ ভূমি ইজারা দেওয়ার বিষয়টিতে ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রচলিত আইনে শুধুমাত্র বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে ভূমি ইজারা প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, সন্নিহিত জলসীমাসহ নদী তীর ব্যতীত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূ–সম্পত্তি, স্থাপনা ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি দরপত্র আহ্বান ছাড়া লাইসেন্স বা ইজারা প্রদান করা যায় না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইনকনট্রেড লিমিটেড ২০০৫ সালে নেওয়া শাহ আমানত বিমানবন্দরের সড়ক সংলগ্ন পূর্ব পতেঙ্গার প্রায় ২৩ একর ভূমির ইজারার মেয়াদ শেষ হতে ১১ বছর বাকি রয়েছে। তারা উক্ত ইজারার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে আট একর খালি জায়গা তাদেরকে ইজারা দেওয়ার জন্য আবেদন করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই জায়গার মেয়াদ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২০ বছরের জন্য বাড়ায়। একই সঙ্গে দরপত্র ছাড়াই বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে ওই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ৮ একর ভূমি ইজারা দেওয়া হয়। ৯ এপ্রিল বোর্ড মিটিংয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২১টি শর্ত উল্লেখ করে ১৫ মে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ইনকনট্রেডের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান, সদস্য (প্রকৌশল), ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) এবং ইনকনট্রেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন।
এই ইজারা প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ এনে ইজারা বাতিলের আবেদন করা হয় বন্দরের বর্তমান নতুন চেয়ারম্যান বরাবরে।
এতে অভিযোগ করা হয়, বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা যেন প্রকাশ না পায় সেজন্য কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এই ধরনের ইজারার ক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষরের দুয়েকদিনের মধ্যে জায়গার দখল বুঝিয়ে দেওয়া হলেও উক্ত ৮ একর ভূমির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের ৫ মাসের বেশি সময় পর গত ৮ আগস্ট এস্টেট বিভাগ থেকে জায়গাটি বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। সরকার পতনের পর তড়িঘড়ি করে কাজটি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছিল।
অভিযোগ করা হয়েছিল, এভাবে গোপনে এবং শুধুমাত্র বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে জায়গাটি ইজারা না দিয়ে যদি দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেয়া হতো তাহলে দিলে একাধিক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেতো। সেখানে সর্বোচ্চ দরদাতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইজারার এককালীন অর্থসহ প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে আরও কয়েক গুণ বেশি হারে ভাড়া আদায় করার সুযোগ ছিল। একইসঙ্গে নিয়ম পালনের ফলে প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করা যেতো। কিন্তু নিয়ম না মেনে ইজারা দেওয়ায় সরকার মোটা অংকের রাজস্ব হারিয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেন। অবশেষে বহুল আলোচিত ওই ৮ একর ভূমির ইজারা বাতিল করে দেয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ৮ একর ভূমির ইজারা বাতিলের কথা স্বীকার করেন। তবে ইনকনট্রেডের নামে দেয়া আগেকার ২২ দশমিক ৭৭৬ একর জমির ইজারা বহাল থাকবে বলে জানান।