এবার বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট উপস্থাপন করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২–২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন তিনি। নতুন এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার কথা বলা হচ্ছে। প্রস্তাবিত এ বাজেট স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট। ক্ষমতাসীন দলের টানা তৃতীয় মেয়াদে চতুর্থ বাজেট। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৪তম বাজেট এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট। তাঁর উত্থাপিত এ বাজেটকে কোভিড–পরবর্তী অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে আওয়ামী লীগ। তারা বলেছেন, ‘এটা গরিববান্ধব, ব্যবসাবান্ধব ও গণমুখী বাজেট। বাজেটে উন্নয়নের ধারা অক্ষুন্ন রাখা এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকির চাপ সামাল দেওয়াসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা হয়েছে। বাজেটে সবদিক বিবেচনা করে নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্তদের বিষয়ে নজর দেওয়া হয়েছে।’ অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, বৈশ্বিক ঝুঁকি কাটিয়ে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার সঙ্গে জনজীবনে স্বস্তি ফেরানোই এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য।
অন্যদিকে, প্রস্তাবিত এই বাজেট নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে তারা (ক্ষমতাসীন) কীভাবে আরও লুট করবে– তার একটা হিসাব হচ্ছে এ বাজেট। তাই বিএনপির কাছে এ বাজেটের কোনো গুরুত্ব নেই।’
আগামী ২০২২–২৩ অর্থবছরে ৬টি বিষয়কে দেশের অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবছরের মত এবার বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। এসব আলোচনার মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে ৬টি চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে। এগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং উচ্চ–অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানো এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়ানো, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানো, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোকে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে বলেছে, বাজেটে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা ঠিক, কিন্তু বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা অপরিপূর্ণ। নীতি কৌশল যা নেওয়া হয়েছে তা অসম্পূর্ণ এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের সাপেক্ষে অপর্যাপ্ত।
অন্যদিকে, শিক্ষায় ব্যয় বাড়ানোর তাগিদ থাকলেও ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ কমেছে। কোভিড পরবর্তী বাস্তবতায় সরকারের এ ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে। ২০২২–২৩ অর্থবছরের জন্য যে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এই অঙ্ক মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই হিসাবে নতুন অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষার পেছনে সরকারের এবারের বরাদ্দ ‘বাস্তবসম্মত’ হয়নি। কিন্তু ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী বলে দাবি করেন ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)।
তবে সামগ্রিকভাবে বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানো হয়েছে যাতে নিম্ন আয়ের মানুষ সুরক্ষা পায়। যত বড় পরিধির বাজেট, বাস্তবায়নে লাগবে তার তত বেশি দক্ষতা। বাজেট উত্থাপন বড় কথা নয়, তার বাস্তবায়নে নিহিত আছে তার সার্থকতা। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেট বাস্তবায়ন করাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁরা বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলোতে এখনও দুর্বলতা রয়েছে। সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা, সক্ষমতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সুশাসনের অভাবে যদি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ঠিক না হয় তাহলে বাজেট বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে।