পয়লা বৈশাখের উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সর্বজনীনতা। এটি সব বাঙালির প্রাণের উৎসব। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের কোনো ধর্মীয় অনুসঙ্গ নেই। এই আনন্দোৎসব হচ্ছে একান্ত সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানোর বিষয়টি এর সঙ্গে যুক্ত হয়। তারই জের ধরে পয়লা বৈশাখে হালখাতা খোলার রীতি চালু হয়। মঙ্গলশোভাযাত্রার মাধ্যমে আমরা আমাদের সকল অন্ধকার, অনাচার দূর করে অনাগত সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করি। আধুনিকতার চেয়েও গ্রামীণ ও লোকজ-পরিবেশে বর্ষ বরণের আয়োজনটা আরো বেশী আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। গান, নাচ, আবৃত্তি ও নাটকের মাধ্যমে যে অনুষ্ঠান সাজানো হয় তাতে অধিকাংশ গ্রামীণ ও লোকজ কাহিনি প্রাধান্য পায়। একসময় গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গান, নাচ, কবিতা, নাটক ইত্যাদির পরিবেশনার মাধ্যমে আমাদের নতুন ও তরুণ প্রজন্ম নিজের সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হয়। অন্তত এই একটি দিন কোনো ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া সকল বয়সের মানুষ একটি জায়গায় একত্রিত হয়। আর একই মনমানসিকতায় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। প্রাণের টানে আগত মহা জনসমাবেশে বিন্দুমাত্র ছন্দ পতন ঘটে না। বৈশাখের প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে সকলেই একত্রে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে থাকে। সেই অনুষ্ঠানেরও কোনো ছন্দ-পতন ঘটে না। এক অনাবিল আনন্দে সকলে বিভোর থাকে। ঢাকা কেন্দ্রিক বর্ষবরণ অনুষ্ঠানগুলো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা, শহর ও গ্রামাঞ্চলের বৈশাখী মেলার আকর্ষণীয় ভূমিকা অনবদ্য। চট্টগ্রামের সি.আর.বি, ডি.সি হিল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ভবনের বৈশাখী উৎসব সবার মাঝে প্রাণের সঞ্চার করে। এসব মেলা আমাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা ভূখন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব হচ্ছে নববর্ষ বরণের এই আনন্দোৎসব। বাঙালির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ঘটে এই উৎসব বরণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আমরা স্বাধীন জাতি। আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে বার বার বাধা আসলেও আমাদের সাহসী ও দৃঢ়চেতা মনোভাব সব বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে চলছে। অতীতের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী আমাদের এই উৎসব আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। সেই সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে দেশীয় সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে আমাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর সেই প্রতিবন্ধকতাকে রুখে দাঁড়াতে ১৯৬০ সালে ঢাকার রমনা উদ্যানের বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব। আমাদের সংস্কৃতিকে বাধা দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে স্তব্ধ করার প্রয়াস ব্যর্থ করে দেয় আমাদের মহান ভাষা সৈনিক, কলম যোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং সর্বোপরি আপমার জনসাধারণ। আপামর জনসাধরণের একাত্মতা আমাদের আর্থপরিচয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত সকলের ভূমিকা অনন্য ও অনবদ্য।
আমাদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের প্রতিবাদী মনোভাব আমাদের অনেক অন্যায়কে প্রতিহত করছে। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আমাদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা প্রথমেই রাস্তায় নামে। নববর্ষ উৎসবের চেতনার সঙ্গে যে প্রতিবাদী চেতনা মিশে আছে সেই প্রতিবাদী চেতনাই আমাদেরকে বার বার নতুন করে স্বপ্ন দেখায়। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে বৈশাখ বার বার আমাদের নতুন আশার সন্ধান করে। যা কিছু পুরানো সব কিছুকে পিছনে ফেলে সামনে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে বৈশাখ আমাদের প্রেরণা যুগিয়ে আসছে। তাইতো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো প্রসারিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের এই বিশাল জনসংখ্যার যে দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে সেই দক্ষতা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। আবাহমান বাংলার বর্ষবরণ উৎসবকে শুধু উৎসবে পরিণত না করে বরং এর মাধ্যমে গৃহীত শিক্ষা ও আদর্শকে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও নৈতিক জীবনে পথপ্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের অক্ষমতা, জড়তা, অঙ্গতা, আড়ষ্টতা, নির্ভরতা সবই আমাদের সৃষ্টি। সমাজে যে হারে অন্যায়, অত্যাচার, হানা-হানী এবং বিভিন্ন অপকর্মগুলো বেড়ে চলছে তাতে আমাদের সৃষ্টির আনন্দটাই মলিন হয়ে যায়। শুধু বর্ষবরণের দিনের নানা অঘটন আমাদের সীমাবদ্ধতাকেই প্রকাশ করে। আর সারা বছর ধরে সে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তাতে আমাদের বিবেক ও সচেতনতাকে বার বার প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। বর্তমানে অন্য সব ছাড়িয়ে আমাদের অগ্রগতি বার বার ধাক্কা খাচ্ছে। এর পেছনে আছে আমাদের সহনশীলতার অভাব, সুশিক্ষার অভাব, মানবিকতার অভাব ও সর্বোপরি বিচারহীনতার অভাব। যে কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইন মেনে চলার আগ্রহ ও শিক্ষা দিন দিন কমে যাচ্ছে। উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত সবাই এক লাফে উচ্চ পর্যায়ে যেতে দৌড়ের মধ্যে আছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। ফলে বর্ষবরণের মাধ্যমে আমরা যে শিক্ষা নিই তা বাস্তবে চর্চা করা হয় না। সবাইকে এক করে সমান ভাবে আনন্দ ভাগাভাগি করার শিক্ষা দেয়। আবার একজন আরেকজনের দু:খ-দুর্দশায় এগিয়ে আসার শিক্ষাও দেয়। কিন্তু বাস্তবে আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা সেই শিক্ষাকে ব্যাহত করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৈশাখ মাসের বৈশিষ্ট নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। তারা বৈশাখ মাসের প্রচণ্ডতাকে ও তীব্রতাকে বেশী জোড় দিয়েছে।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম