বাঙালির শোকের দিন

জাতীয় শোক দিবস আজ

রাশেদ রউফ | সোমবার , ১৫ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট, বাঙালির শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের বৃষ্টিঝরা শ্রাবণের এই দিনে বাংলার বুকে বৃষ্টির বদলে ঝরেছিল রক্ত। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে বয়ে চলেছিল সেই রক্ত। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে জাতির পিতার বুক থেকে ঝরেছিল লাল রক্ত ঠিক রক্তগোলাপের মতো। এই দিনে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে রচিত হয়েছিলো এক কালিমালিপ্ত অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুদের প্ররোচনায় মানবতার দুশমন, ঘৃণ্য ঘাতকরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক চক্র আর কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের চক্রান্তের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এই হত্যাকাণ্ড। সেনাবাহিনীর এক দল বিপথগামী সদস্যের বুলেটের নির্মম আঘাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল এবং দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল। ইতিহাসের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে সেদিন আরো প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগনে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু খানসহ অনেকে। এ কারণে বেদনাবিধূর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন আজ। এখানে উল্লেখ করতে পারি, সেদিন আল্লাহর অসীম কৃপায় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, ‘বিশ্ব ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়; জনগণের হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতা এবং সব মহতী আকাঙ্ক্ষাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাসকেও। কিন্তু খুনিদের সে ষড়যন্ত্র টেকেনি। জাতি ও বিশ্বমানবের মানসপটে বঙ্গবন্ধু আজও সমহিমায় উজ্জ্বল, চিরভাস্বর। ১৫ আগস্টের অভিশপ্ত দিনটিতে বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরানো হয়েছিল; দীর্ঘ ৩৪ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সে কলঙ্ক থেকে জাতির দায়মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে পিতা হত্যা এবং ষড়যন্ত্র ও অবৈধ ক্ষমতা দখলের ঘৃণ্য ও তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ের অবসান ঘটে।’

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একটা অংশে লিখেছেন : ‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান’, আর একটা হলো আমরা বাঙালি। ‘পরশ্রীকাতরতা’ আর ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতর বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্য বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে’। বাঙালি যে কত বড় বিশ্বাসঘাতক, তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরীও বাঙালিদের বিশ্বাসঘাতক বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বেও মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।’
বঙ্গবন্ধুকে নানা অভিধায় আখ্যায়িত করা যায়। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়; শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমিরবিদারি সূর্য। তিনি ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতা, বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের বাঙালি জাতির পিতা।

লোকসাহিত্য বিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক-গবেষক শামসুজ্জামান খান তাঁর এক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে: ‘পৃথিবীর প্রত্যেক ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রনায়কই মূলত লেখক, দার্শনিক বা চিন্তক; তা না হলে তিনি শুধুই রাজনীতিক মাত্র। ফলে সংস্কৃতিমনস্কতা তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই যেসব রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং রাষ্ট্রদর্শন ও মানবিকতার আদর্শগত তাত্ত্বিকতায় বুৎপত্তি অর্জন করেছেন তাঁরা লেখক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়ক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, ইংল্যান্ডের উইনস্টোন চার্চিল, ভারতের মহাত্মা গান্ধী এবং পণ্ডিত নেহেরু বা সেনেগালের সেংঘর বা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা এঁরা সকলেই খ্যাতকীর্তি রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতাসংগ্রামী বা মানবতাবাদী লেখক-দার্শনিক এবং সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ও ইতিহাস ব্যাখ্যাতা। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার নায়ক মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন বা মাওসেতুং, হোচিমিনও তেমনি। অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়, আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এঁদের ধারায় নিজেকে বিন্যস্ত করেছিলেন। তাঁরও এঁদের মতো একটি স্বকীয় রাষ্ট্রদর্শন ছিল, উপনিবেশ উত্তরকালে নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদী ও আধা ঔপনিবেশিক ধাঁচের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রণনীতি ও কৌশল ছিল। এবং সে বিষয়ে তাঁর নিরন্তর সারাদেশব্যাপী জনসংযোগ, অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা প্রদান, সুচিন্তিত অমোঘ কর্মসূচি ঘোষণা এবং দীর্ঘ কারাবরণ ও নির্যাতন সহ্য করে দেশকে স্বাধীন করার গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেই দীর্ঘ কারাবরণ-কালকেও তিনি অপচয়ে যেতে দেননি। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে লিখেছেন তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এবং প্রকাশিতব্য স্মৃতিকথা ও আগরতলা মামলার বিবরণসমৃদ্ধ রচনা। এই লেখালেখির ফলে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু প্রমুখের মতো নিজেকে ভিন্নতর উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’

আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, মহান স্বাধীনতার রূপকার। জাতির পিতার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শাসকদের ধারাবাহিক শোষণ, দমন-পীড়ন, ঔপনিবেশিক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর দীর্ঘদিনের নির্যাতন-নিপীড়ন-বৈষম্যের অপমান থেকে বাংলার জনগণকে মুক্তির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। সেদিন তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ অমর আহ্বানেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয় নিপীড়িত কোটি বাঙালি।

বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, গোটা জাতির স্বপ্নের রূপকার। তাঁর ‘ইস্পাতকঠিন নেতৃত্ব আর অভীক লড়াকু সত্তা’ বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অধিকার আদায়ের অনিঃশেষ প্রেরণা। তিনি বাঙালির বিশ্বজয়ের মহানায়ক এবং ঐক্য, প্রেরণা ও স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইনি জটিলতায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আনা যাচ্ছে না
পরবর্তী নিবন্ধসুপার গ্লু দিয়ে লাগানো ছাগলের শিং!