বাঙালির ডিসেম্বর

ছন্দা চক্রবর্ত্তী | সোমবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

ডিসেম্বর মাস বাঙালি জাতির জীবনে একটা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মাস। এই মাসেই বাঙালি জাতির বহুল আকাঙ্ক্ষিত সাধনার ধন মহান মুক্তিযুদ্ধের মহাবিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাস বলে পহেলা ডিসেম্বরকে সরকারি ভাবে মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালনের প্রস্তাব জানিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে রাখার জন্য এ প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধ করার পর বিজয় লাভের মাধ্যমে বাঙালি জাতি একটি নতুন জাতি ও একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ নামে পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিল। আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটি লাল সবুজের পতাকা, একটা নির্দিষ্ট সীমানা বেষ্টিত মানচিত্র,ও একটি দেশ বাংলাদেশ।

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স এখন একান্ন। একান্ন বছর আগে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের মালিক হয়েছি, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এর মাধ্যমে। এ বিজয় লাভের পিছনে আছে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আপামর বাঙালির বহু ত্যাগ তিতিক্ষা সহ ত্রিশ লক্ষ শহিদের তাজা রক্ত ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর মত বীরাঙ্গনার আত্মদান এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের শহীদ হওয়া মিত্রবাহিনীর আত্মত্যাগ। এতসব ত্যাগ যাঁর নির্দেশনায় সংগঠিত হয়েছিল, তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির কণ্ঠস্বর, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, ৭ মার্চের ভাষণের স্রষ্টা, বিশ্ব ঐতিহ্য প্রামাণ্য দলিলে স্থান পাওয়া বক্তব্য এর অংশীদার, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিজয়ের মাসে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

আজ এই বিজয়ের মাসে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতাকে, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁরই নির্দেশে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা করেছেন। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে গভীর কৃতজ্ঞতা একাত্তরের বীর সেনাদের। সহমর্মিতায় শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি বীরঙ্গনা মা বোনদের।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার প্রথম লক্ষ্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন এর শৃঙ্খলমুক্তি অর্জিত হয়েছিল। তাই তো এই মাস আমাদের শৃঙ্খলমুক্তির মাস, আনন্দের মাস, মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াবার মাস। এই মাসে আমাদের ফেসবুক ওয়াল এ ভাইরাল হয় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজীর আত্মসমর্পণ এর ছবি। যে ছবিতে দেখা যায়, নিয়াজী আত্মসমর্পণ এর দলিলে স্বাক্ষর দিচ্ছে, বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী প্রধান, ভারতীয় সেনাপ্রধান জগজিৎ সিং অরোরার কাছে।

এছবিও আমাদেরকে আনন্দে ভাসায়। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, একাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম, তাদের কাছে হয়তো একটি ছবি মাত্র, কিন্তু আমাদের কাছে এটি একটি স্মৃতিকাতরতায় ভরা আবেগীয় মুহূর্তের স্মরণীয়ক্ষণ। এই ক্ষণের পর থেকেই আমরা বিজয় লাভ করেছি। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের মালিক হয়েছি। লাল সবুজের পতাকার অধিকার বাস্তবায়ন হয়েছে। যে লাল বৃত্তের রং এ মিশে আছে আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের লাল রং।আর সবুজ, এদেশের উর্বর শ্যামলিমায় ভরা সবুজ প্রকৃতি।

এতসব মহাযজ্ঞ মূলক কর্মকাণ্ডের মূলনায়ক ছিলেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর অদম্য সাহস, একাগ্রচিত্ততা, বাঙালিত্বের গৌরব, অসমপ্রদায়িক চেতনা ইত্যাদির মাধ্যমে ধারাবাহিক ভাবে ১৯৪৮ এর আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয়দফা কর্মসূচি, আগরতলা ষড়যন্ত্র, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যূত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন সবক্ষেত্রেই ভরসার ছাতা হয়ে বাঙালির নিউক্লিয়াস হয়ে উঠেছিলেন।

তাঁর অসীম সাহসের এবং দূরদর্শী কৌশলী সিদ্ধান্ত পুর্ণ ৭মার্চের ভাষণ ছিল সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করতে প্রস্তুত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মারণাস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে দেওয়া এক অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয়, চিরস্মরণীয়, কাব্যসৌরভ ও কাব্যগৌরবের সংমিশ্রণে গাঁথা এক মঙ্গলময় মহাকাব্য। ১৮ মিনিটের এই মহাকাব্য বাংলার আকাশ, বাতাস ও সাধারণ জনগণ এর হৃদয়ে অনুরণনের ঝংকার তুলে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রণায় দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করার ভীত রচিত হয়েছিল সেই রেসকোর্স ময়দানে।

এই দেশের মানুষের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না। ছিল মুজিবের অমিয় বাণী- ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো’। এই রকম কিছু জাগরণি লাইন। এই লাইনগুলো শোনার জন্য এবং যুদ্ধে যাওয়ায় বীজমন্ত্র নিতে যারা উপস্থিত হয়েছিল তাদের বিবরণ দিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় লিখেছেন-‘কপালে, কবজিতে লাল শালু বেঁধে /এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, /লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক ;/পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।/হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত, /নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুন কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে /আর তোমাদের মতো শিশু পাতা কুড়ানিরা দল বেঁধে’।

রেসকোর্স ময়দানের উপস্থিত এরা সকলেই হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে পুরো বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর”ভাইয়েরা আমার বলে শুরু করা ১৮ মিনিটের বজ্রকণ্ঠ, যেটা শেষ হয়েছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। নামক বীজমন্ত্রের শব্দগুচ্ছ দিয়ে। যে শব্দগুচ্ছের চেতনা ছড়িয়ে পড়লো সবখানে, যেন রবিঠাকুরের গানের মতো- এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে। সেখান থেকে শুরু হয়েছিল মুক্তি যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের উপর ২৫মার্চ এর গণহত্যার পর ভোরে অর্থাৎ ২৬মার্চ বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর মুহূর্তে এদেশের মানুষ দলে দলে মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও এদেশের সাধারণ জনগণ নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী মিলিত ভাবে নয় মাস যুদ্ধ করার পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ এর মাধ্যমে বিজয় লাভ হয়। এযুদ্ধে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছিল ভারতের তৎকালীন সরকার প্রধান শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

১৯৭১ এ এত ত্যাগ ও রক্তদান এর বিনিময়ে পাওয়া এই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার এই বাংলাদেশ, রইলো না স্থায়ী হয়ে। তিন বছর যেতে না-যেতেই ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির কপালে লেপ্টে দিল কলঙ্ক তিলক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলো কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্য। ইতিহাস এর নিষ্টুরতম ঘটনার সাক্ষী পিতৃহত্যার দায়ভারে জর্জরিত হয়ে রইলো এই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি।বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে, সচেতন দেশপ্রেমিক হিসাবে, মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছে একটাই আর্তি- ‘ক্ষমা করো পিতা অধম সন্তানে’। খুনীদেরকে ইতিমধ্যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিছু খুনি এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।শারীরিক ভাবে মুজিবের মৃত্যু হলেও মানুষের ভালোবাসার মুজিবের কখনো মৃত্যু নেই। যত দিন যায় ততই মৃত মুজিব জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে মানুষের মন মানসে আরো বেশি শক্তিশালী স্থানে অবস্থান করছে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায় বলা যায়–

‘ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের দোহাই
অযুত বীরঙ্গনার সম্‌ভ্রমের ক্ষীরা
আবার আসবে এক মহাপ্লাবন
জন্ম নেবে আর একবার শেখ মুজিবর
ঘরে ঘরে জেগে উঠবে এক একটি শেখ মুজিবর’।

কবির আশার মতো বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রার্থনা আমাদের, প্রতিটি ঘরের মধ্যেই মুজিবের আদর্শিক চেতনার মূল্যবোধ সমৃদ্ধ প্রজন্মের উত্থান ঘটুক। বাংলাদেশ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠুক। তবেই হবে কষ্টার্জিত ত্যাগ তিতিক্ষার সাগর পেরিয়ে পাওয়া অর্জিত বিজয় বা আনন্দ বেদনার স্মৃতি বিজরিত ডিসেম্বর এর অবদান, আমাদের বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি যখন ভাষণ দিতে গিয়ে, নিজের পরিবারের কথা, অতীত এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আবেগে আপ্লূত হয়ে চোখের জলে ভাসেন, আমরাও যারা মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণ, তাদের হৃদয়েও এ বেদনা হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে, আমরা ও আবেগে শোকাতুর হই। কিন্তু কেউ কেউ যখন সমালোচনা করেন এই বলে, এতো পুরানো কাহিনী, আর কতদিন শুনতে হবে! তাদের জন্য বলা, এইসব কাহিনী নয়, এইসব জাতিকে পঙ্গু করার রূঢ় বাস্তবতা। আমাদের অন্তরে গাঁথা বেদনার মহাকাব্য। সমালোচনাকারীদের বোঝার কথা নয়। কারণ

‘যতদিন ভবে না হবে না হবে
তোমার অবস্থা আমার সম,
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে যাতনা মম’।

ডিসেম্বর মাস বাঙালি জাতির কাছে আনন্দ বেদনার, বিজয়ের, গৌরবের আত্মমর্যাদার এবং আত্মবিশ্বাস ফিরে ফিরে পাওয়ার মাস। জয় হউক বিজয় দিবস। জয় বাংলা।

লেখক: প্রাবন্ধিক; অধ্যক্ষ হুলাইন ছালেহ-নূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন চলবে জীবনের নিয়মেই
পরবর্তী নিবন্ধগণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী