এটি সর্বজনবিদিত যে, বিশ্বের প্রায় সকল জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপনের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রীতিনীতি দীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিপুল সংখ্যক দেশে জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি বা আদিবাসী প্রত্যেকেই প্রায় নিজস্ব পঞ্জিকা বা নির্ধারিত তারিখ অনুসারে নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় জাতিগত স্বজাত্য কৃষ্টির অনুশীলনকে ধারণ করে আসছে। মূলতঃ এরই প্রেক্ষিতে তৈরী হয়েছে বিভিন্ন মাত্রিকতায় বিশ্বজনীন আধুনিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। অন্যান্য বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠীর মত বাংলা নববর্ষের প্রচলন ও উদযাপন ভারতবর্ষের কৃষি কাঠামোর পরিবর্তন বাস্তবতায় উদ্ভাসিত। এদেশে কিছুকাল ধরে অপরিণামদর্শী, সংকীর্ণ একদেশদর্শী এবং বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে বিভিন্ন মাত্রায় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত ছিল এবং আছে। আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বা অন্যান্য জাতি যেমন– ইংরেজ, তাইওয়ান, স্কটিস এবং ইউরোপীয় অনেক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নানাবিধ প্রক্রিয়ায় এবং উৎসবের আমেজে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে।
প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলন সভ্যতায় এবং ইরান, চীন, ভিয়েতনাম, লাওস সহ প্রায় দেশে প্রাচীনকাল থেকে নববর্ষ উদযাপনের প্রেক্ষাপট অনেকে জ্ঞাত আছেন। লাওসের নববর্ষ উৎসব যে দিন থেকে শুরু হয়, সেটি ঠিক আমাদের দেশের ১লা বৈশাখ। বাংলাদেশে বাঙালি জাতি ছাড়াও বিভিন্ন উপজাতি যেমন – চাকমাদের ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ‘বিষু’, অহমিয়াদের ‘বিহু’ এবং সর্বোপরি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে বর্ষ বিদায় ও বরণতাদের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখার বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে এখনও ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। নিজস্ব বর্ষ–পঞ্জিকার সূত্র ধরে নববর্ষের বিভিন্ন উৎসব উদযাপন অত্যাধিক সমাদৃত। বাংলাবর্ষ বিদায় ও নববর্ষের অবগাহন আজ শুধু গ্রাম বাংলায় নয় বাংলাদেশের প্রতিটি নগর, শহরসহ যেকোন অঞ্চলে এমনকি বিশ্বের নানা দেশে প্রবাসী বাঙালিদের আনন্দ উদযাপনের বিশেষ দিন হিসেবে বাংলা নববর্ষ তার মহিমায় ভাস্বর।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, নববর্ষের বাংলা সনের ‘সন’ শব্দটি আরবী, পহেলা বৈশাখের ‘পহেলা’ শব্দটি ফারসী এবং বছরের প্রারম্ভে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রচলিত ‘হালখাতা’ শব্দটি ইসলামী। মুঘল সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরী (চান্দ্র বর্ষ) ২ রবিউসসানি, রোজ শুক্রবার, ইংরেজী ১৪ই এপ্রিল ১৫৫৬ সাল থেকে ১লা বৈশাখ পালনের রেওয়াজ শুরু করেন। সৌর বৎসর (বঙ্গাব্দ) ও চান্দ্রবর্ষ (হিজরী) উভয়ের অপূর্ব সন্ধিক্ষণে রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূক্ষ্ন হিসাব–নিকাশের মাধ্যমে শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে ১লা বৈশাখকে নববর্ষ উদযাপনের দিন হিসেবে ধার্য্য করা হয়। এই বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল হিজরী সনকে উপেক্ষা করে নয় বরং হিজরী ৯৬৩ সালকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে। শুধুমাত্র ফসল তোলার সময়কে সৌর বর্ষের সাথে সামঞ্জস্য করার লক্ষ্যে সূর্য্যকে মানদন্ড ধরে সৌরবর্ষ অথবা ফসলি বর্ষ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই সৌরবর্ষ ও চান্দ্র বৎসরের ব্যবধানকে যথাযথভাবে সংযোজিত করে নতুন বঙ্গাব্দের পরিচয় বহনে এই দিনের প্রারম্ভ। আসলে এটি চান্দ্র ও সৌর বৎসরের নবতর সম্মিলন।
নক্ষত্র মন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারাসমূহের অবস্থানের উপর ভিত্তি করেই বঙ্গাব্দের বার মাসের নামকরণ করা হয়েছে। সূর্যসিদ্ধান্ত নামে জ্যোতীর্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ থেকে নেয়া নক্ষত্র তথা বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, মৃগশিরা, পুষ্যা, মঘা, উত্তরফাল্গুনী, চিত্রা ইত্যাদির নামানুসারে বাংলা মাসের নাম যথাক্রমে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ন (মাঘশীর্ষ), পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্রের নামকরণ হয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই, বর্ষ গণনায় সেসময় প্রতিটি মাসের ৩০ বা ৩১ প্রতিটি দিনের নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহানই বিভিন্ন গ্রহ–নক্ষত্রের নামানুসারে পুরো মাসকে সপ্তাহে বিভক্ত করে দিনগুলোর নামকরণ করেছিলেন এবং পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রবিবারকে সপ্তাহের ১ম দিন হিসেবে ধার্য্য করেছিলেন। সূর্য দেবতার নামানুসারে রবিবার, শিব দেবতার নামানুসারে সোমবার, মঙ্গল গ্রহের নামানুসারে মঙ্গলবার, বুধ গ্রহের নামানুসারে বুধবার, বৃহস্পতি গ্রহের নামানুসারে বৃহস্পতিবার, শুক্র গ্রহের নামানুসারে শুক্রবার এবং শনি গ্রহের নামানুসারে শনিবার রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
অতএব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, এই বঙ্গাব্দের প্রচলন এবং এই নববর্ষকে বরণ করার যে প্রক্রিয়া বা অনুষ্ঠান তা সকল কিছুই মুসলমান শাসকদেরই সৃষ্ট এবং চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতিরই পরিবর্তিত বাহন। এটি শুধু বাঙালি জাতীয় কৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে না, বাঙালি সমাজের কৃষি ও অন্যান্য আর্থ–সামাজিক প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে নতুন অলংকারে ভূষিত। সাধারণত: বাঙালি সংস্কৃতির ব্যাপকতা এবং গভীরতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা নববর্ষ এক বিশেষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত শুধুমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির শাশ্বত ও সাবলীল ঐতিহ্যিক কারণে। আমরা জানি যে, সংস্কৃতি বলতে শুধুমাত্র কোন বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর নাচ গান, শিল্প–কলা, আচার–আচরনকেই শুধু নির্দেশিত করে না। সামাজিক জীব হিসেবে জীবন যাত্রার পরিমন্ডলকে সুসংহত করার সামগ্রিক পরিবেশের নামই সংস্কৃতি। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে মানুষের চিন্তা–চেতনা, ধ্যান–ধারণা, জ্ঞান–বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি ইত্যদি যেমন সংস্কৃতির অংশ; তেমনি সামাজিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার সামগ্রিক ক্ষেত্রে সামাজীকিকরণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সকল উপাদানই সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত।
যদিও অনেক ক্ষেত্রে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বাস্তবে এদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও পরিপূরক হলেও কোনভাবেই একাত্নবোধক নয়। বস্তুগত উপাদান সভ্যতার অবদান হলেও এগুলোর উদ্ভাবন ও প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় মানবসৃষ্ট সামাজিক রীতিনীতি সভ্যতাকে সংস্কৃতি থেকে ভিন্নতা দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “সভ্যতা হল একটি হীরের টুকরো, আর তার থেকে বিচ্ছুরিত আলো হলো সংস্কৃতি।” আর এজন্যই সংস্কৃতির পরিমাপ সভ্যতার মাপের চেয়ে বহুলাংশে জটিল। এটি অনুধাবনের বিষয় যে, এই সংস্কৃতির ভিত্তিই হচ্ছে সামাজিক কাঠামো এবং এর চরিত্র ও গুণগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত কাঠামোকে কেন্দ্র করে। সেজন্য বস্তুবাদী দর্শন থেকে সংস্কৃতিকে বলা হয় উপরি কাঠামো অর্থাৎ মৌল কাঠামো বা বিদ্যমান সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি যার উপর নির্ভর করে সে সমাজের ধর্ম, দর্শন, জ্ঞান–বিজ্ঞান, আদর্শ, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচরণ ইত্যাদি। আমাদের আজকের যে সাংস্কৃতিক দৈন্যতা এই উপমহাদেশের দীর্ঘ আড়াইশ বৎসরের ঊপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসকেই দায়ী করে। বাংলার এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি ছিল কিংবদন্তীর মত বাংলার সম্পদ ও ঐশ্বর্য। এর ভিত্তিতে এই দেশে যে সংস্কৃতি পরিচর্যা পরিণত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান পর্যটকের বর্ণনায় ওঠে এসেছে।
ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ার মন্তব্য করেছিলেন যে, মিসরকে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও বাংলাদেশে দুবার পরিভ্রমণের পরে এই দেশের প্রাচুর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অতিথিদের প্রতি মাধুর্য্য ও লাবণ্যভরা দৃষ্টিভঙ্গী এমন মোহিত পরিবেশের সৃষ্টি করে যাতে বলা যায় বাংলায় ঢুকার শত পথ বা দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও বেরিয়ে যাওয়ার তেমন কোন পথ উন্মুক্ত নেই। এভাবেই গ্রাম কাঠামোর ভিত্তিতে সৃষ্ট সংস্কৃতির ঐতিহ্য বাঙালি জাতি ধারণ করেই জাতি আজ এই মঙ্গলময় অসামপ্রদায়িক ও সমপ্রীতি পরিচর্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা এও জানি যে, প্রায় হাজার বছরের আগে প্রাকৃত ভাষার উপাদান সমৃদ্ধ বর্ণময় ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার জন্ম। পরবর্তীতে বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গল কাব্য ইত্যাদি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। আসলেই প্রকৃত অর্থে ইউরোপে রেঁনেসাসের ফসল হিসেবে যে মানবিকতার অবগাহন, এই বাংলাতেও ষোড়শ শতক তথা বাংলা নববষের্র প্রচলনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানবতাবাদীএক নবতর সংস্কৃতির জন্ম দেয়। যার ফলে বাংলার কবির কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আজ এদেশে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন বিশেষ করে পাশ্চাত্যের নষ্ট সংস্কৃতি এবং অন্য দেশের ভোগ বিলাসী সংস্কৃতির যে বিস্তার, তা আমাদের ঐতিহ্যের মূলে কিভাবে কুঠারাঘাত করছে তার মূল্যায়ণ অতীব প্রয়োজন। অল্প কিছু গণমাধ্যম বা আকাশ সংস্কৃতির উন্নত প্রযুক্তির প্রসারে প্রচন্ডবেগে ভঙ্গুর অপসংস্কৃতির বিভিন্ন বাহন আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যিক ধারণার প্রকৃত উপাদান, বিশ্বাস ও প্রকাশের প্রতিকী মূল্যাবোধগুলো কঠিন সংঘাতের মুখোমুখি হচ্ছে। এইসব অপচর্চা স্বজাত্যবোধের ঐক্য ও সংহতিকে কতটুকু অগ্রগতি বা প্রগতির চেতনায় সমৃদ্ধ করবে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এসব সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংঘটিত সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বকে মুক্ত করার বলিষ্ঠ উপায় হচ্ছে নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালির সংস্কৃতিকে অধিকতর সমুজ্জল করার আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। যথাযথভাবে এই নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি সকল প্রকার কূপমন্ডুকতা, অনগ্রসরতা, অশুচি, অন্যায়–অবিচারের কলুষিত অন্ধকারকে নিধন করে মানবিকতার আলোয় অধিকতর প্রজ্বলিত সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট হবে – এটিই আজকের দিনের প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী।