বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তিগত ব্যয়বৃদ্ধির কারণ ও প্রতিকার প্রসংগে

ডা. হাসান শহীদুল আলম | শুক্রবার , ১৩ মে, ২০২২ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তিগত ব্যয় বলতে কি বুঝায়?
ধরা যাক একটি স্বাস্থ্যসেবায় মোট এক হাজার টাকা খরচ হলো। সরকারি সুবিধা অর্থাৎ বহিঃবিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ ও ওষুধপত্র বাবদ ৩০০ টাকার সুবিধা পাওয়া গেল। রোগীকে আরও ৭০০ টাকার ওষুধ নিজের খরচে বাইরের ফার্মেসী থেকে কিনতে হলো। এখানে মোট স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের মধ্যে রোগীর ব্যক্তিগত ব্যয় ৭০ শতাংশ এবং সরকারের ব্যয় ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশে চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় :
(ক) চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশীঃ
‘বাংলাদেশে একজন রোগীকে নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬৮.৫ শতাংশ। এই হার ভারতে ৬৩, পাকিস্তানে ৫৬, নেপাল ও শ্রীলংকায় ৫১, মালদ্বীপে ২১ ও ভূটানে ১৩ ভাগ ( ডিপেনডেন্ট ২৪ ডট কম. ২১-১১-২১)’।

(খ) চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্রতা বাড়ছেঃ
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের মানুষের পকেটের ব্যয় বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ১ কোটি ১৪ লাখের বেশী মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছে (প্রথম আলো, ১৯-১২-১৯)।

গ) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বলঃ
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, কোনো দেশে কোনো নাগরিকের স্বাস্থ্য ব্যয় তার সামগ্রিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশী হলে সেই দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩০ টাকা এবং বাকী ৭০ টাকা রোগী নিজে বহন করে (বিডিনিউজ ২৪ ডট কম. ১১-০৮-২০)’।

চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় কিভাবে হচ্ছে :
ক) ‘গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে রোগীকে সবচেয়ে বেশী টাকা ব্যয় করতে হয় ওষুধ খাতে ৬৪ ভাগ। এরপর হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে ২৩ ভাগ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যয় হয় ৮ ভাগ টাকা ’(ডিপেনডেন্ট ২৪ ডট কম. ২১-১১-২১)।
চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় বছর বছর বেড়েই চলেছেঃ

ক) বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ একাউনটস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে একজন ব্যক্তিকে তার চিকিৎসা ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ বহন করতে হতো। আর সরকারি ব্যয় ছিল ৩৭ শতাংশ’। (সমকাল, ১২-১২-২১)।

খ) ‘২০২২ সালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ৭০ ভাগ টাকা ব্যক্তিকে বহন করতে হয়’ (ভ্যানগার্ড, ফেব্রু, ২০২২)।

গ) দেখা যাচ্ছে, দুই যুগের ব্যবধানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ব্যক্তির ব্যয় ১৫ শতাংশ
বেড়েছে। আর সরকারি ব্যয় কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ।

চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় বৃদ্ধির কারণ :
ক) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে নীতি নির্ধারকদের ভ্রান্ত ধারনাঃ

১) নীতিনির্ধারকদের ধারনা চিকিৎসা মানেই সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। মূলত চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশ মাত্র।
২) নীতিনির্ধারকদের ধারনা আগে প্রতিকার, তারপর প্রতিরোধ। বরং হওয়া উচিৎ আগে প্রতিরোধ, তারপর প্রতিকার। সকল রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ভালো রাখার ব্যবস্থা সত্ত্বেও কেউ রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিকারের প্রশ্ন আসবে।

৩)‘স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকে এক করে ফেলার শিকড় যে কতটা গভীরে প্রোথিত সেটা বোঝা যায় বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) ধারায় স্বাস্থ্য নয় বরং চিকিৎসাকে মৌলিক প্রয়োজন হিসাবে স্বীকৃতি দানের ভেতর দিয়ে’। ( গণসংহতি, ১৩-০৮-২০)
৪) বাজেটে স্বাাস্থ্যখাতকে খরচ হিসাবে দেখা।

খ) বাস্তব চাহিদা দেখা হয়নাঃ
স্বাস্থ্যখাতের বাজেট তৈরীর সংগে যুক্ত ব্যক্তিরা বাস্তব চাহিদার উপর ভিত্তি করে বাজেট তৈরী না করে আগের বছরের বাজেটের চেয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পরের বছরের বাজেট তৈরী করেন।

গ) স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারীকরণঃ
সরকারের এরূপ ভ্রান্ত নীতি বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বাণিজ্যিকিকরণের দিকে নিয়ে যাবার ফলে রোগীদের ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে
ঘ) স্বাস্থ্যখাতকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়াঃ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দকে বিশ্ব যেখানে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের সাথে তুলনা করছে সেখানে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আয়োজনেই এই খাতকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে,

ঙ) বাজেটে স্বাস্থ্যখাত অবহেলিত থাকাঃ বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিও বিবেচনায় অন্যান্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্যখাত বাজেটে বরাবরই কম গুরুত্ব পেয়েছেঃ
১) ‘জাতিসংঘের ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দি প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি এর বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশে’ ( সিপিডি ডট বিডি ১০-০৬-২০)।
২) সিপিডি এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ’বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য এই পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। এ খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা। এ কারণে মানুষকে নিজের পকেট থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো খরচ করতে হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকী ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। এই টাকা খরচ করা অনেক মানুষের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়’ ( সিপিডি ডট বিডি ১০-০৬-২০ )।

৩) ‘জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেছেন, ’সক্ষমতার অভাব, কিছুটা দুর্বৃত্তায়ন আছে, একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে যারা এগুলি অপচয় করে- সবকিছু মিলে আমূল সংস্কার দরকার। রোগীর চাপ অনেক বেশী, কিন্তু তাদের জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। রোগীর জন্য যে বরাদ্দ সেটাও কিন্তু খুবই কম’ (সিপিডি ডট বিডি ১০-০৬-২০ )।
চ) সরকারি খাতের অব্যবস্থাপনাঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাস্থ্যসেবাদাতা সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প বরাদ্দ, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও জরাজীর্ণতার প্রতীক হয়ে আছেঃ

১) সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক নার্স সহ জনবল ঘাটতি থাকা,
২) হাসপাতালগুলোতে ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকাঃ
‘হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয়া ৯৭ শতাংশ রোগীই ওষুধ পান না। চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ তাদের কিনতে হয় ফার্মেসী থেকে ’( মানবজমীন, ১৮-০৪-২২)

৩) সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগনির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ওটেকনিশিয়ান ঘাটতি থাকাঃ
‘৮৫.১ শতাংশ পরীক্ষা নীরিক্ষাই রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনসটিক সেন্টারে’ (মানবজমীন, ১৮-০৪-২২)
৪) ব্যবস্থাপনার দুর্নীতিঃ
সরকারি হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের টাকা না দিলে সিট, ওষুধ, অপারেশনসহ চিকিৎসার সিরিয়াল না মেলা,
স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তিগত ব্যয় হ্রাস করণে করণীয়ঃ

ক) স্বাস্থ্যখাতকে দেশের ইনভেসটমেন্ট হিসাবে দেখা,
খ) স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো,
গ) বরাদ্দকৃত অর্থ খরচের সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা,
ঘ) ওষুধের সাপ্লাই প্রয়োজনীয় পরিমাণে ও ওষুধ মানসম্পন্ন হতে হবে,
ঙ) ওষুধের জন্য হাসপাতালসমূহে আলাদা ফান্ড থাকা,
চ) জনবল প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো এবং জনবলের দক্ষতা বাড়ানো,
ছ) রোগ নির্নয়ের জন্য যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকটের সমাধান করা,
জ) ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি রোধ করা,
ঝ) স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসাঃ

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনসটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, সার্বজণীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারনায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে নিজের পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় ৩০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে পারলে তা সহনীয় পর্যায়ে আসবে’ (ভোরের কাগজ, ০৭-০৪-১৮)

উপসংহারঃ
এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, নীতি নির্ধারকদের ভ্রান্ত ধারনার অবসান ঘটিয়ে স্বাস্থ্যখাতে যথাযথ বরাদ্দ বাড়িয়ে জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকটের সমাধান করা অতীব জরুরি। সে সংগে ব্যবস্থাপনার দুর্নীতিও রোধ করতে পারলে তখনই স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তিগত ব্যয় কমে আসবে বলে মনে করি।

লেখক: চর্ম যৌন রোগ ও ডায়াবেটিসে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়তলীতে ৪ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা