বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী | শনিবার , ২০ মে, ২০২৩ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার অবদান অপরিসীম। অবরোধ প্রথার শেকল ভেঙে তিনি বেরিয়ে আসেন প্রচণ্ড সাহস আর প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তিনি বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন নারীকে শিক্ষা, দীক্ষায় পুরুষের সমকক্ষ করে তুলতে, লড়াই করেছিলেন নারীর মুক্তির জন্য।

আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর আগে বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের পথ দেখিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন নারী বেঁচে থাকুক তার আপন মর্যাদায়। সেই অর্থে প্রশ্ন থেকেই যায় নারী কি আদৌ ততটা এগিয়ে যেতে পেরেছে? পরাধীনতার শেকল ভেঙে নারী কি আজও পেরেছে মুক্ত হতে? আমরা মুখে যতই নারী স্বাধীনতার কথা বলি না কেন সত্যিকারের স্বাধীনতা কি আজও এসেছে নারীর জীবনে, তাদের যোগ্য অধিকার বা সম্মান তারা কতটুকু পাচ্ছে!

আমরা দেখি প্রতিবছর নারী দিবসে মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশে মুখরিত থাকে দিনটি। নারীর অধিকার নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলা হয় অথচ সমাজের বেশিরভাগ নারীই রয়ে গেছে এখনও অন্ধকারে। এই অন্ধকারে থাকা নারীদের বাদ দিয়ে কখনও নারীর জাগরণ সম্ভব নয়। নারী শ্রমিকরা আজও পায় না তাদের ন্যায্য অধিকার, পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেও বৈষম্যের শিকার তারা।

শুধু কি তাই ঘরে বাইরে সর্বক্ষেত্রে নারীরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, শোষিত এবং নির্যাতিত হয়ে আসছে। কতজন নারী নিজের মতন করে চলতে পারেন, নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, মুখ বন্ধ করে কতকিছুই মেনে নিতে হয়, প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পর্যন্ত থাকে না।

খুব ছোটবেলা থেকেই একটা মেয়েকে অনেক বিধি নিষেধের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয় এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। লোকে খারাপ বলবে, যখন তখন ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, মেয়েদেরকে অনেক ধৈর্যশীল হতে হয়। সামান্য ভুলত্রুটির জন্য হাজারটা মন্দ কথা শুনতে হয়। মাথায় ঢোকানো হয় শ্বশুরবাড়িই তার আসল বাড়ি, সেখানে সবার মন রক্ষা করে চলতে হবে। রান্নাবান্না না জানলে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কী করবে আরও কত কী!

কিন্তু একজন ছেলেকে কখনো এধরনের কথাবার্তায় অভ্যস্ত হয়ে বড় হতে হয় না। বেশিরভাগ পিতামাতাই মনে করেন মেয়েকে একজন সুপাত্রের হাতে দিতে পারলেই তাদের জীবন সার্থক। পড়ালেখাটা না হয় বিয়ের পরেই শেষ করবে, যদি শ্বশুরবাড়ির সকলের সম্মতি থাকে। এমনও অনেককে বলতে শুনেছি, খুব ভালো ঘর পেয়েছি ওরা মেয়েকে পড়াবে বলেছে। অনেক মেয়েকেও আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলতে শুনি, ‘বিয়ের পর ওরা আমাকে পড়াশোনা করতে দেবে, চাকরিও করতে দেবে’। আবার অনেক স্বামীও গর্ব করে বলে থাকেন, ‘আমি কিন্তু আমার স্ত্রী কে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেই’। একইভাবে অনেক স্ত্রীকেও বলতে দেখি, ‘আমার স্বামী আমাকে অনেক স্বাধীনতা দেয়’। দুঃখ হয় সেইসব নারীদের জন্য যারা বোঝে না স্বাধীনতা কেউ দিতে পারে না, জীবনে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারার যে ক্ষমতা সেটাই স্বাধীনতা।

কোনো নারীকে কিন্তু কখনো বলতে শোনা যায় না, ‘আমার স্বামীকে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেই’ কেননা সেটা পুরুষের জন্মগত অধিকার তাই সমাজে ‘পুরুষ স্বাধীনতা’ বলে কোনো শব্দ শোনা যায় না। আর নারীকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য পরিবার হতে শুরু করে আশেপাশের মানুষের অভাব হয় না, তাইতো ‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দটি চারিদিকে এত প্রচলিত।

আবার যে মেয়েটি বিয়ের পর চাকরি করবে তাকে আগে সংসার সামলাতে হবে, তারপর চাকরি। যুগ যুগ ধরে এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই পড়ে যায় নারী দিবসকে সামনে রেখে একটা বিজ্ঞাপন নিয়ে, যেখানে একজন উদ্যোক্তা নারীর ছবির সাথে পোস্ট করা হয়েছে ‘ঘরও সামলাই, ব্যবসা ও সামলাই’।

বিজ্ঞাপনদাতা খুবই গর্বিত, একজন নারী ঘরও সামলাচ্ছে আবার ব্যবসাও! কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনে কি কোনো পুরুষের ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে ‘ঘরও সামলাই, ব্যবসা বা চাকরিও সামলাই’! অবশ্যই না কেননা এই বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র নারীদের জন্য। সমাজ নারীকে এভাবেই দেখতে চায় আগে সে ঘর সামলাবে তারপর অন্যকিছু। এই সমাজ কখনো একজন পুরুষকে বলে না সে আগে ঘর সামলাবে তারপর চাকরি বা ব্যবসা। সেই বিজ্ঞাপনে একজন নারী ঘর সামলিয়ে ব্যবসা করছে সেটা তার সফলতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছে কিন্তু সেটা সমাজের কোন নারীর জন্য উদাহরণ হতে পারে না। একজন নারী ঘর সামলাবে, নাকি চাকরি করবে, নাকি ব্যবসা করবে সেটা সম্পূর্ণ তার নিজের সিদ্ধান্ত। এইসব সস্তা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নারীদের যুগ যুগ ধরে ছোট করা হচ্ছে যা নারীর উন্নয়ন বা সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

এখন তো সময় পরিবর্তন হওয়ার কথা, নারীপুরুষ সকলেই সমানভাবে ঘর সামলাবে। অথচ আমরা এইসব বিজ্ঞাপন দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। এরকম অনেক বিজ্ঞাপনই আছে যেখানে নারীদের সফল দেখাতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হেয় করা হয়, অসম্মান করা হয়।

আবার কোনো মেয়ে পড়ালেখা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে বিয়ে বা সংসারটাকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বা সংসারই করতে চাইলো না তখনই শুরু হয়ে যায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের গুঞ্জন, নিশ্চয় কোন সমস্যা আছে বা চরিত্রের দোষ আছে তা না হলে বিয়ে করছে না কেন!

সমাজে একটা ত্রিশ বছরের অবিবাহিত ছেলের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, ৩০ বছরের অবিবাহিত মেয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন, যতই সে শিক্ষিত হোক না কেন! মেয়েটি তখন সমাজের চোখে করুণার পাত্রী হয়ে যায়।

এভাবে দিনের পর দিন নারীরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, নারীদের প্রতি এইসব আচরণ যেন স্বাভাবিক ঘটনা।

তাছাড়া নারীরা এখনও অন্ধ কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। তারা বেরোতে পারছে না তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক রীতিনীতি বা প্রথা থেকে। হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী আগের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে, পুরুষের পাশাপাশি তারাও সমাজের জন্য অবদান রেখে চলেছেন। প্রশাসনের উচ্চপদে নারীরা আজ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন, এভারেস্ট জয় করে নিয়েছেন নারী। সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীতে মেয়েরা কাজ করছেন, সাংবাদিকতায়, আইনপেশায়, ব্যাংকের উচ্চ পদে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে, শিক্ষকতা পেশায় আজ নারীরা দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। নারী শিক্ষিত হওয়া মানে পুরো মানবজাতি শিক্ষিত হওয়া। নারীকে অন্ধকারে রেখে শুধুমাত্র পুরুষের একক অংশগ্রহণে কখনো মানবজাতির উন্নতি সম্ভব নয়।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে নারীর অবস্থান কোথায় তা সুস্পষ্ট, অল্প কিছু সংখ্যক নারীর সাফল্য কখনও সমস্ত নারীর দৃষ্টান্ত হতে পারে না। তারপরও বলবো একদিন বাংলাদেশের নারীরাও জেগে উঠবে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নারীরাই পারে অন্ধকার থেকে বের হয়ে আলোর দ্যুতি ছড়াতে। যেদিন সকল নারী তার নিজের সম্মানে সম্মানিত হবে, নিজের স্বাধীনতা নিজেই নিশ্চিত করবে, ভাবতে পারবে সেও একজন আলাদা মানুষ সেদিনই নারীর সফলতা আসবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমার জন্য নিও না বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে