গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কাছে ৪০০ কোটি টাকা আটকে থাকার জের ধরে লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নির্ধারিত বার্থিং সভাও গতকাল বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক গড়ে ৫০টিরও বেশি জাহাজ বহির্নোঙরে গেলেও গতকাল একটিও যায়নি। আটকে রাখা ভাড়া নিয়ে দেখা দেয়া এ সংকটে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজজট সৃষ্টিসহ আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের আশংকা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্দরে সাড়ে আট মিটার ড্রাফট ও ১৯২ মিটারের বেশি লম্বা জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না। এ ধরনের জাহাজে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টন পণ্য বহন করতে পারে। এর থেকে বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজগুলো বহির্নোঙরে অবস্থান করে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে আসা বড় মাদার ভ্যাসেলগুলোকে এ প্রক্রিয়ায় পণ্য খালাস করতে হয়। আবার কিছু কিছু জাহাজ ড্রাফট কমানোর জন্যও বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করে। বন্দরের বহির্নোঙরে বর্তমানে বছরে নয়শ’রও বেশি মাদার ভ্যাসেল হ্যান্ডলিং হয়। এসব জাহাজে অন্তত ছয় কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানার কাঁচামাল। বন্দরের ওভার সাইটেও বিপুল পরিমাণ পণ্য লাইটারেজে বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করা হয়। বন্দর ও বহির্নোঙর থেকে বন্দর চ্যানেলের নানা ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানে এসব জাহাজ পণ্য পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রামস্থ সিইউএফএল ও কাফকোর উৎপাদিত সারের একটি অংশও বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন জেলার গুদামে লাইটারেজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজের স্বাভাবিক চলাচলের ওপর বন্দর বহির্নোঙরসহ দেশের পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক পুরোপুরি নির্ভর করে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বেশ কিছু লাইটারেজ রয়েছে। এর বাইরে সাধারণ আমদানিকারকদের পণ্য পরিবহনের ব্যাপারটি ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ডব্লিউটিসি প্রতিদিনই বার্থিং সভা করে আমদানিকারকদের চাহিদার বিপরীতে লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
নিয়মানুযায়ী ডব্লিউটিসি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করে জাহাজ বরাদ্দ ও ভাড়া আদায় করে। এরমধ্যে আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্টগণ ডব্লিউটিসির তালিকাভুক্ত লোকাল এজেন্টদের কাছ থেকে জাহাজ ভাড়া নেয়। ভাড়ার টাকা ডব্লিউটিসির নিকট প্রদান করা হয়। ডব্লিউটিসি আদায়কৃত ভাড়া লোকাল এজেন্টকে প্রদান করে। লোকাল এজেন্ট ভাড়া প্রদান করে জাহাজ মালিকদের। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে ৩৩ জন পণ্যের এজেন্ট এবং ৬০ জন লোকাল এজেন্ট রয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ খাতে পণ্য পরিবহনের পুরোটাই এদের উপর নির্ভরশীল। আবার অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতের এই কর্মকান্ডের উপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কার্যক্রম থেকে শুরু করে দেশের আমদানি বাণিজ্য। লাইটারেজ চলাচলে কোন সংকট দেখা দিলে পুরো ব্যবস্থাপনায় ধস নামে।
জাহাজ মালিকরা পণ্যের এজেন্টদের কাছে চারশ’ কোটিরও বেশি ভাড়ার টাকা আটকে থাকায় জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এতে দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনও বন্ধ হয়ে যাবে।
গতকাল ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ২০ জনের মতো পণ্যের এজেন্টের কাছে চারশ’ কোটিরও বেশি টাকা আটকা। বহুদিন ধরে এই টাকা আটকা পড়ে আছে। এক একজন পণ্যের এজেন্ট ২০/৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত আটকে রেখেছেন। নানা তাগাদা দেয়া হলেও ভাড়ার এই টাকা তারা পরিশোধ করছেন না। অপরদিকে জাহাজ পরিচালন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।ব্যাংক ঋণের সুদের যোগান দিতে দিশেহারা বহু জাহাজ মালিক।
এ ব্যাপারে গতকাল একাধিক লোকাল এজেন্ট (জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জাহাজ মালিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কোটি কোটি টাকা আটকা পড়ে আছে। জাহাজের জ্বালানি কেনা কিংবা শ্রমিকদের খোরাকি দেয়ার পরিস্থিতিও নেই বহু জাহাজ মালিকের। অথচ ওই জাহাজের বিপরীতে লক্ষ লক্ষ টাকা ভাড়া আটকে রাখা হয়েছে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা সম্ভব না হলে জাহাজ চালানো অসম্ভব বলেও তারা মন্তব্য করেন।
এব্যাপারে একাধিক পণ্যের এজেন্ট গতকাল বলেছেন, আসলে আমরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে টাকা এনে ডব্লিউটিসিতে প্রদান করি। আমদানিকারকরা সংকটে থাকলে আমাদের বিল আটকে রাখেন। এক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে।
ডব্লিউটিসির প্রধান নির্বাহী মাহবুব রশিদ গতকালের নির্ধারিত বার্থিং মিটিং বাতিল করার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কোন জাহাজই বহির্নোঙর থেকে পণ্য খালাস করতে যায়নি। কখন যাবে তাও ঠিক নেই।