ষড়ঋতুর আবর্তে এসেছে বসন্ত। শীতের জীর্ণশীর্ণ প্রকৃতি নববধূর সাজে মেতে ওঠে সৃষ্টির উৎসবে। দখিনা মৃদু মৃদুু হাওয়ায় মনে জাগে শিহরণ। কোকিলের তান আর পাখ পাখালির কিচির মিচির শব্দে চারদিক করে তুলে প্রাণের জাগরণ। বসন্তে ফোটা নানা ফুলের সমারোহ প্রকৃতিকে করে তুলে অপরূপা। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, মাধুরীলতা, কাঠচাঁপা, করবী, কনকলতা, কনকচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, নাগকেশর, দেবকাঞ্চন, পলাশ, শিমুল, পারিজাত, টগর, পারিজাতের সৌন্দর্য প্রকৃতিকেই শুধু রাঙিয়ে দেয় না, মানবমনকেও রাঙিয়ে তোলে। মৃদুমন্দ সমীরণ প্রাণে প্রাণে মিলনের উচ্ছ্বাস ঘটায়। তখন আবেগী মন প্রিয়জনের ছোঁয়া অনুভব করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ফুলের বনে যার পাশে যাই তারে লাগে ভালো। নজরুলের ভাষায়, ‘আসে বসন্ত ফুলবনে, সাজে বনভূমি সুন্দরী’, ‘মনের রঙ লেগেছে বনের পলাশ জবা অশোকে’। বসন্ত নিয়ে কবিদের উচ্ছ্বাস অন্তহীন। বসন্তের সৌন্দর্যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আহা আজি এ বসন্তে এতো ফুল ফোটে, এতো পাখি গায়’, ‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো, জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ’, বসন্তকাল নজরুলের মননকেও নানাভাবে আন্দোলিত করেছে, তাঁর বৈচিত্র্যময় ভাবনার প্রকাশ পায় তাঁর গানের চরণে- ‘আজও দখিনা হাওয়ায় ফাগুন জাগে’, ‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল’, ‘ফুটলো যেদিন ফাগুনে হায় প্রথম গোলাপ কুঁড়ি প্রভৃতি গানে। নজরুলের প্রথম সন্তান বুলবুল বসন্ত রোগে অকালে চলে যায়। তাই বসন্ত তাঁর কাছে ছিল কিছুটা মলিন ও বিমর্ষ। তাই তিনি গেয়েছিলেন ‘তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ পাণ্ডুর হল আকাশের চাঁদ’। ভালোবাসার রঙ আবীর মেখে পৌরাণিক চরিত্র রাধাকৃষ্ণ প্রেম অনুরাগ প্রকাশ করে ঋতুরাজ বসন্তে। তাই প্রেমের কবি নজরুল গেয়েছেন, ‘ব্রজগোপী খেলে হোরী.. পিরীতি ফাগমাখা গৌরীর সঙ্গে, হোরী খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে, বসন্তে এ কোন কিশোর দুরন্ত। বসন্তের শুরু একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে যেখানে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা ও বিকাশে বাঙালিরা বসন্ত উৎসব প্রতিবছর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পালন করে আসছে। বাঙালির হৃদয়ে নিরন্তর উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে বসন্তকালীন দোল উৎসব, লোকজ মেলা, একুশে বইমেলা ও বসন্তবরণ অনুষ্ঠান। বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতুর দেশে কালে কালে বসন্ত আসে নতুন রঙ, নতুন কুঁড়ি, কোকিলের ধ্বনি আর যৌবনের গান নিয়ে। সকল জীবের মধ্যে জাগে স্বপ্ন ও জীবনবোধ। বসন্তের সৌন্দর্যে স্বপ্নের আলপনা এঁকে মানবপ্রেমিকেরা নবউদ্যমে পথচলার প্রেরণা খুঁজে পায়। তাই এ স্নিগ্ধ মধুময় লগ্নে আমার প্রত্যাশা, ফুলের ঘ্রাণে পাখির গানে বসন্ত ছুঁয়ে যাক সবার প্রাণে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক