পঞ্চবার্ষিকী করপুনমূল্যায়নের মাধ্যমে নির্ধারিত ১৬০ কোটি টাকা পৌরকর পরিশোধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। তাই প্রস্তাবিত এ পৌরকর আদায়ে ‘অনড়’ চসিক এবার দ্বারস্থ হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে। এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার নৌপরিবহন সচিব বরাবর দাপ্তরিক পত্রও দিয়েছে সংস্থাটি।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পৌরকর নির্ধারণে ২০১৭ সালে পঞ্চবার্ষিকী করপুর্নমূল্যায়ন করে চসিক। এতে চবকের কাছে প্রস্তাবিত পৌরকর ছিল ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে পঞ্চবার্ষিকী করপুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম স্থগিত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। যা ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর প্রত্যাহার করা হয় (কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে)। এরপর চবককে পুনর্মূল্যায়নের আলোকে পৌরকর পরিশোধ করতে বলে চসিক। কিন্তু আপত্তি জানায় সংস্থাটি।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৪ জুলাই চসিক ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করতে বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও। ওই বৈঠকে ৫০ কোটি টাকা পৌরকর চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু বন্দর পরিশোধ করে ৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ শতাংশ সারচার্জ মওকুফের সুবিধা নিয়ে পরিশোধ করে মাত্র সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত চসিকের সাধারণ সভায় তা অনুমোদন দেন তৎকালীন মেয়র রেজাউল।
সর্বশেষ ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নগর উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি বাড়াতে চলতি অর্থবছর (২০২৪–২০২৫) থেকে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পৌরকর আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন। যা গত বছরের (২০২৪) ১৫ ডিসেম্বর চবক চেয়ারম্যানকে দাপ্তরিক পত্র দিয়ে জানিয়ে দেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এতে চলতি অর্থবছরে বন্দরের পরিশোধিত অংক বাদ দিয়ে বাকি ১১৫ কোটি ১৬ টাকাও পরিশোধ করতে বলা হয়। কিন্তু ওই চিঠি দেয়ার মাস পেরুলেও বকেয়া পরিশোধ করেনি চবক। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয় চসিক। ওইদিন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় চসিক প্রধান নির্বাহীর। এছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে নৌপরিবহন সচিবকেও দাপ্তরিরক পত্র দেয় চসিক। এতে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকর পরিশোধে চবককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে বলা হয়।
চবক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেয়া চসিকের পৃথক দুটি পত্রেই বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে। ফলে এ অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল রাখতে সড়ক–মহাসড়কগুলো সচল রাখা এবং এর সার্বক্ষণিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য চসিক নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাস্তার ধারণক্ষমতা ৬–১০ টন হলেও ৫০–৬০ টনের বোঝা নিয়ে ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন গাড়ি চলাচল করায় নগরীর অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী সড়কগুলো এ কারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে নিয়মিত রাস্তা–কালভার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এতে নগরবাসীর চলাচলে যানজটসহ চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জনগণের চলাচলের জন্য সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এসব রাস্তাঘাট সংস্কার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা জোগান দেওয়া সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এ
ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চসিককে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষকে লিখেছিলাম। এখন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে লিখেছি। আশা করি এবার রেজাল্ট আসবে।
জানতে চাইলে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, সার্ভিস চার্জ হিসেবে বন্দরের কাছে তাদের আয়ের ১ শতাংশ অর্থ চেয়েছিলাম। এটা তাদের আইনের কারণে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই ১৬০ কোটি টাকার যে পৌরকর আমরা পাব সেটাই চেয়েছি। বন্দর সেটা দিতে প্রস্তুত। তাদের বোর্ড সভায় বিষয়টি অনুমোদনও হয়েছে। বন্দর পরিচালনা পর্ষদ সদস্য (অর্থ) মোহাম্মদ শহীদুল আলমকে দিয়ে একটি কমিটিও হয়েছে। এখন তারা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য লিখবেন। আশা করি তারা পৌরকরের পুরোটাই পরিশোধ করবেন।
মেয়র বলেন, নগরের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সেবার পরিধি সম্প্রসারণে যে আর্থিক সক্ষমতা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে যথেষ্ট অপ্রতুলতা রয়েছে চসিকের। তাই বন্দর থেকে ন্যায্য পৌরকর পেলে নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহজ হবে।
এ বিষয়ে জানার জন্য বন্দর পরিচালনা পর্ষদ সদস্য (অর্থ) মোহাম্মদ শহীদুল আলমের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও সাড়া দেননি।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের পূর্বে চবকের স্থাপনার বিপরীতে পৌরকর ধার্য করা হয়েছিল ২০১১ সালে। একই বছরের নভেম্বর মাসে দুই সংস্থার মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। এর আলোকে ওই অর্থবছর থেকে পৌরকর বাবদ ৩৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা পরিশোধ করে চবক। যা সারচার্জ মওকুফের সুযোগ নিয়ে সংস্থাটি ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে।
এছাড়া ২০১৭ সালের পুনর্মূল্যায়নের উপর ২০২১ সালের ১৪ জুলাই চসিক ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকে ধার্য হয় ৫০ কোটি টাকা। এর আলোকে ২০১৭–২০১৮ অর্থবছর থেকে ২০২০–২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর বকেয়া বাবদ সাড়ে ১০ কোটি টাকা করে ৪ বছরে ৪২ কোটি উসুল বাদ বকেয়া দাবি করে চসিক। কিন্ত ২০২০–২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না বলে চসিককে ওই সময় জানিয়ে দেয় চবক।
এর আগে ১৯৯৪–৯৫ অর্থবছরে ৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা পৌরকর দাবি করলেও চবক ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করত। তবে ২০০১–০২ অর্থবছরে চসিক বকেয়া ১৯৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা দাবি করে। ওই সময়ে বন্দরের আপত্তিতে চসিক অনড় থাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে। পরে দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে চবক ২০১২ সালে ১১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করে চসিককে।