বন্দরের পণ্যবাহী গাড়ি থেকে টোল চায় চসিক

কাল মেয়রের প্রস্তাব যাচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ২৫ মে, ২০২৪ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

নগরের বেশিরভাগ সড়কের ধারণ ক্ষমতা ৬ থেকে ১০ টন। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের ৫০ থেকে ৬০ টন ওজনের পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করে এসব সড়ক দিয়ে। এতে দ্রুত নষ্ট হয় সড়ক। শহরের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বছরে খরচ হয় ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। বিপরীতে এ খাতে বন্দর থেকে এক টাকাও পায় না সংস্থাটি। অবশ্য গৃহকর খাতে চসিককে বছরে সাড়ে ৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করে বন্দর।

এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্যবাহী যান থেকে ‘টোল’ আদায় করতে চায় চসিক। এক্ষেত্রে বন্দরের মালামাল ও কন্টেনার পরিবহনে ব্যবহৃত সমস্ত ট্রাক, লরি ও কন্টেনার ক্যারিয়ারের বিপরীতে নির্দিষ্ট টোল ‘সিটি সার্ভিস চার্জ’ হিসেবে ধার্য করার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিচ্ছে চসিক। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে এ বিষয়ে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি উপানুষ্ঠানিক পত্র (ডিও) আগামীকাল রোববার পাঠানো হবে। চসিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের বাৎসরিক আয় থেকে চসিককে ১ শতাংশ হারে প্রদানের দাবি ছিল বিভিন্ন মহলে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন২০২২ এর খসড়ায় বন্দরের মোট আয়ের এক শতাংশ চসিককে প্রদানের বিষয়ে প্রস্তাবনাও ছিল। যদিও পরবর্তীতে চূড়ান্ত আইনে তা সন্নিবেশিত হয়নি। এ অবস্থায় বিকল্প হিসেবে বন্দরের পণ্যবাহী যান থেকে টোল হিসেবে আদায়ের দিকে জোর দেন মেয়র। এ বিষয়ে গত মাসে বন্দর দিবসের অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে মেয়রের।

নৌপরিবহন মন্ত্রীর কাছে ডিও পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, আমি নৌপরিবহন মন্ত্রীকে বলেছি, বন্দরের আয় থেকে ১ শতাংশ দেয়ার বিষয়টি আইনগত বাধার জন্য হচ্ছে না। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে লোডআনলোড করা প্রতিটি কন্টেনার থেকে সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ দিতে হবে। যত ট্রাকলরি বন্দর থেকে বের হবে সেখানে টোল আদায় করতে হবে এবং সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হবে। তিনি বলেন, কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রিতে বিভিন্ন চার্জ আদায় করা হয়, সেখানে কর্পোরেশনের জন্য যদি সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ যুক্ত করা হয় কর্পোরেশনের আয় বাড়বে।

চসিকের চাওয়া কতটা যৌক্তিক : সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং জাপান আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) যৌথ সমীক্ষার অংশ হিসেবে গত বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সীতাকুণ্ডের ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করে। এতে দেখা যায়, ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ যান নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ওজন বহন করে। আবার নির্ধারিত সর্বোচ্চ ওজন সীমা হচ্ছে ৫২ টন (সাত এঙেল বিশিষ্ট যানবাহনের ক্ষেত্রে)। এসব অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবাহী বেশিরভাগ যান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এসেছে।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কন্টেনারসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহন হয়েছে ১১ কোটি ৮৫ লাখ টনের বেশি। এছাড়া গত বছর ৩০ লাখের বেশি কন্টেনার পরিবহন হয়েছে বন্দর দিয়ে। এসব পণ্যভর্তি কন্টেনারের সিংহভাগ পরিবহন হয়েছে সড়ক পথে। অর্থাৎ বন্দরের পণ্যবাহী যানের চাপ বাড়ছে নগরের সড়কে।

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সমীক্ষা অনুযায়ী, নগরের সিইপিজেড থেকে নিমতলা পর্যন্ত সড়কে চলাচল করা গাড়ির ৩৭ শতাংশ ট্রাক ও লরি। এই সড়কে গণপরিবহণ চলে মাত্র ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বারিক বিল্ডিং থেকে নিমতলা পর্যন্ত অংশেও চলাচল করা গাড়ির ৩৫ শতাংশ ট্রাক ও লরি। এখানে গণপরিবহন চলে ৯ শতাংশ। অর্থাৎ চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিতে গণপরিবহনের চেয়ে ট্রাক ও লরি বেশি চলাচল করে। মূলত এসব লরি ও ট্রাকের সিংগহভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানিরপ্তানি হওয়া পণ্য বহনে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সড়কটি সাধারণ মানুষের চেয়েও বেশি ব্যবহার হয় চট্টগ্রাম বন্দরের কাজে।

অবশ্য সড়কটি ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্যবাহী যান বেশি চলাচল করে স্ট্র্যান্ড রোড, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, সিডিএ অ্যাভিনিউ, আগ্রাবাদ এঙেস রোড, আরাকান রোড ও মেরিনার্স রোড ও জাকির হোসেন রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য সড়ক দিয়ে। এসব সড়ক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজার ট্রাক চলাচল করে বলে ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যানের জরিপে উঠে আসে। বেটার্মিনাল ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে যা ২০৩০ সালে এক লাখ ১৩ হাজারে উন্নীত হবে। অর্থাৎ বন্দরকে ঘিরে চলাচল করা গাড়ির চাপ বাছে নগরের সড়কে।

কী থাকছে মেয়রের প্রস্তাবে : চসিক সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব পাঠানো হবে তাতে গত বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর করেন মেয়র। এতে বলা হয়, চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাস্তা ৬১০ টন বোঝার গাড়ির জন্য নির্মাণ করা হলেও ৫০৬০ টনের বোঝা নিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। হাজার হাজার ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করায় নগরের অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর, জেটি হতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সড়কে অসংখ্য ভারী যানবাহন চলাচল করে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী সড়কগুলো এ কারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। এসব ভারী যানবাহনের কারণে নিয়মিত রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে নগরবাসীর চলাচলে যানজটসহ চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জনগণের চলাচলের জন্য সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এসব রাস্তাঘাট নিয়মিত সংস্কার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন যা সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

মেয়র চট্টগ্রাম বন্দরের মালামাল ও কন্টেনার পরিবহনের জন্য আগত সকল ট্রাক, লরি ও কন্টেনার ক্যারিয়ার হতে আলাপআলোচনার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল সিটি সার্ভিস চার্জ হিসেবে ধার্যপূর্বক বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা আদায় করে চসিককে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেন। মেয়র বলেন, ওই অর্থ ব্যয় করে বন্দরের পণ্যবাহী গাড়িসমূহের ব্যবহৃত রাস্তাসমূহের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একইভাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য সড়কসমূহ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করে বন্দর নগরীর জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ অবকাঠামো নিশ্চিত করা সহজতর হবে।

সিটি মেয়রের একান্ত সচিব মো. আবুল হাশেম আজাদীকে বলেন, সড়র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি বন্দর নগরী হওয়ায় এ সংক্রন্ত সুযোগ সৃষ্টির জন্য বাসট্রাক টার্মিনাল নির্মাণসহ নানা খাতে বছরে সিটি কর্পোরেশনের ৬০০৭০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এক্ষেত্রে বন্দর থেকে টোল পেলে সড়ক মেরামত ব্যয় নির্বাহ করা সহজ হবে চসিকের জন্য।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মে অনুষ্ঠিত চসিকের প্রাক বাজেট (২০২৪২৫ অর্থবছর) আলোচনায়ও বন্দর থেকে ‘সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ’ আদায়ে একমত পোষণ করেন সুশীল সমাজ। ওই সভায় মেয়র বলেন, আমাদের করা রাস্তায় বন্দরের অতিরিক্ত ওজনের গাড়ি চলাচল করে। আমরা রাস্তা এ বছর করলাম, পরের বছর দেখা যায় তা কর্ণফুলী নদীর ঢেউয়ের মত হয়ে গেছে। গাড়ি চলতে পারে না।

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, শহরে যেসব ট্রাক লরি প্রবেশ করে তা কর্পোরেশনকে ট্যাঙ দেয়া ছাড়া ঢুকতে পারবে না।

জানা গেছে, গত বছরের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উন্নয়ন কার্যক্রম সংক্রান্ত একটি সমন্বয় সভায় অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বন্দর থেকে কর্পোরেশনের জন্য প্রস্তাবিত রাজস্ব আদায়ে চসিককে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে চসিকের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর বক্তব্যের জের ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘বন্দর চেয়ারম্যানকে বলেন। যদি এটা না হয়, বলেন, রাস্তাঘাটতো অনেকে বন্ধ করে দিয়েছে, আমিও বন্ধ করে দিব।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধফল উৎপাদনে বিস্ময়
পরবর্তী নিবন্ধওয়াকওয়ে চালু কোরবানির ঈদে,গাড়ি চলবে জুলাই থেকে