“কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবাবি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী”।
জাতীয় কবির এই পংক্তিযুগলের উপযুক্ত উদাহরণ নিরবে নিভৃতে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কাজ করে যাওয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে শুধু বঙ্গবনন্ধুর সহধর্মিণী হিসাবে নয়, একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে নিরবে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছেন তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এই নামটি বাংলার মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসার নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো বটেই, বঙ্গবন্ধুর পূরো রাজনৈতিক জীবনে ছায়ার মত পার্শ্বে ছিলেন তিনি। ফলে একটি জাতির মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন-বীজ বপন করে কিশলয় বানিয়ে এর ফলের স্বাদ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পিছন থেকে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি কর্মকান্ডের নেপথ্যের কারিগর এই অসামান্যা নারী। নিজে আড়ালে থেকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা, ভরসা এবং সাহস দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। সংসারের সমস্ত ভাবনা থেকে নির্ভার রেখেছেন তাঁকে যাতে তিনি দেশের জন্য নিশ্চিন্তে কাজ করে যেতে পারেন। তাঁর সহ্য-ক্ষমতা ছিল অসাধারণ; নিজে বঞ্চিত হয়েও হাসিমুখে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছেনে অন্যতম কারণ। বঙ্গমাতা আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের এক কিংবদন্তি।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। সবচাইতে মর্মান্তিক সত্য হল আগস্ট মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন আবার আগস্ট মাসেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু ও পরিবার-পরিজন নিয়ে একই সাথে ঘাতকদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করতে হয়। তিন বছর বয়সে বাবার এবং ৫ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু হলে বঙ্গবন্ধুর মায়ের কাছেই বড় হতে থাকেন তিনি। পারিবারিক সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। শাশুড়ির স্নেহে বড় হতে থাকা রেণু নিজের আগ্রহে বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছিলেন। পড়াশুনার অভ্যাসটা পরবর্তী জীবনেও ধরে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীর পড়াশুনা এবং রাজনীতির কারণে অধিকাংশ সময়েই স্বামীর কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে তাঁকে। একাই সংসার, সন্তান সামলে নিয়েছেন অবিচল ভাবে অথচ স্বামীর কর্মকান্ডে কখনো বাঁধা না হয়ে অণুপ্রেরণা যুগিয়েছেন সর্ব-সাধ্য। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন তিনি।
খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পিছনে অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের পূরোটা সময় ব্যয় করেছেন জনগণের সেবায়, দেশের কল্যাণে। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময় বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছে জেলে। সেই সময়গুলোতে কান্ডারির মত হাল ধরেছিলেন বেগম মুজিব। ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বার বার জেলে যেতে বাধ্য হচ্ছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতা কর্মীরা বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাতেন। এসময় তিনি নিজের অলংকার বিক্রি করে সংগঠনের চাহিদা মিটিয়েছিলেন। ছয় দফা দাবিকে আরও বেগবান করতে ছাত্রলীগের মমতাময়ী অভিভাবক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রনেতাদের অনুপ্রাণিত করেন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিনি দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতেন। ছাত্রলীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সংগঠন চালাতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে খুব নাজুক অবস্থায় পড়ে যান। তিনি বঙ্গমাতার কাছে লিফলেট ছাপানোর জন্য ৫০ টাকা চাইলেন। সে সময় বঙ্গমাতার কাছে বাজার-সওদার খরচা বাবদ মাত্র ৫০ টাকাই ছিল। তিনি নির্দ্বিধায় পুরো টাকাটাই তুলে দিলেন আব্দুর রাজ্জাকের হাতে।
বঙ্গমাতার কাছে ছাত্রলীগ নেতারা যতবারই দেখা করতে যেতেন, ততবারই তিনি সাক্ষাতের মূল কারণগুলো জেনে প্রয়োজন মিটিয়ে বিদায় বেলায় পরামর্শ দিতেন, আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি ভালো ফল করার। তিনি বলতেন, ’ওটা করলে তোমার সব দরজা খুলে যাবে, রাজনীতিরও’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন জাতির পিতা জেলে, তখন তাকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোরে বৈঠকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু বেগম মুজিব প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে দৃঢ়চেতা অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে যোগ না দেওয়ার অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু সেদিন সহধর্মীণির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যা স্বাধীনতাকে আরো তরান্বিত করে।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানেও নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এর পেছনেও ছিল তার সঠিক দিক নির্দেশনা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক আলোচনায় বঙ্গমাতাকে স্মরণ করে ৭ মার্চের বিষয়ে বলেছেন:
“যে কোন সময় যে কোন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমার মা একটা কাজ করতেন, আব্বাকে কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু থেকে একেবারে আলাদা করে রাখতেন, আইসোলেশনে নিতেন, বলতেন অন্তত: ১৫টা মিনিট তুমি এখানে চুপচাপ শুয়ে থাক। সেই সময় আমি আব্বার মাথার কাছে বসা, আস্তে আস্তে আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, আব্বার শরীরটাও একটু খারাপ ছিল, একটু জ্বরও ছিল। আমার মা মোড়া পেতে বসলেন। বসে শুধু একটা কথাই বললেন। আজকে লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাতে বাঁশের লাঠি, আর পিছনে পাকিস্তানীদের বন্দুক। এই মানুষগুলির কথা তোমাকে ভাবতে হবে আর লক্ষ্যে পৌছতে হবে। অনেকে অনেক কথা বলবে, অনেকে অনেক পরামর্শ দিবে। তুমি সারাটা জীবন এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছ, এদেশের মানুষ কি চায় এবং কিভাবে তুমি তোমার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে তা তুমিই ভাল জান, তোমার থেকে ভাল কেউ জানে না, কাজেই তোমাকে কারো কথা শোনার দরকার নাই। এই কথাটার উপর মা খুব বেশী জোর দিলেন যে, কারো কথা শোনার দরকার নাই তোমার মনে যে কথাটা আসবে তুমি শধু সেই কথাটা বলবে।”
তারপর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে জায়গা করে নিল। ভাষণে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা পেয়ে গেল।
আন্দোলনের উত্তাল সময়গুলোতে নিজ বাড়িতে পরম মমতায় নির্যাতিত নেতা-কর্মীর আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন করাতেন। তাদের অসুবিধার কথা শুনে ব্যবস্থা নিতেন। আশাহত নেতা-কর্মীরা খুঁজে পেতেন আশার আলো। আন্দোলনে তীব্রতা নিয়ে আসতো বেগম মুজিবের আশা জাগানিয়া বক্তব্য।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংগে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেও দিশেহারা হননি তিনি। কঠিন সময়ে দৃঢ়তা বজায় রাখার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য নিজের দুই বীর সন্তান শেখ কামাল ও শেখ জামালকে মুক্তি যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। যোগাযোগ রেখেছেন মুক্তি সংগ্রামীদের সাথে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাঙালির অহংকার, নারী সমাজের প্রেরণার উৎস। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর সমস্ত কর্মকান্ডের মাঝে বঙ্গমাতার নিরব অবদান রয়েছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা’। বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতেও তিনি সহায়তা করেছিলেন। অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে মর্যাদা সম্পন্ন জীবন দান করেন তিনি।
মাতৃস্নেহে যত্ন করতেন সবাইকে। দেশের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। বাঙালির অধিকার আদায় ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতার কোন আকর্ষণ ছিল না। বঙ্গমাতাও সেই আদর্শে নিজেকে ও নিজের সন্তানদের গড়ে তোলেন। সহধর্মিণী হিসাবে নয় রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা দায়িনী হয়ে পার্শ্বে ছিলেন। তিনি জীবনভর অন্যের সেবা করে এসেছেন। নারীর উন্নয়নের জন্যে এবং নারীর স্বনির্ভরতা লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। তার সেই সব গুণই ধারণ করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনদরদী, দেশপ্রেমিক ও সাহসী রাষ্ট্রনেতা, তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। মায়ের মতই জননেত্রী শেখ হাসিনা তার হৃদয় নিংড়ানো মমতা, পর্বতসম অবিচলতা আর নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে জনগণের সেবা করে যাচ্ছেন।
তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ জুড়ে বহু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটছে। বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এমন এক মেয়ের জন্ম দিয়েছন যে মা, বাঙ্গালি জাতির আত্ম পরিচয়ের জন্য, বাঙালির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন যে মা সেই বঙ্গমাতার অবদান এই মাটিতে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া এই মহিয়সী নারী বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে কি অবদান রেখেছেন তা শুধুমাত্র কিছু শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এমন একজন সহধর্মিণী থাকায় জাতি পেয়েছে একজন বঙ্গবনন্ধুকে।
বাঙালি জাতি আজ মহা শোকাহত। ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে সপরিবারে নির্মম বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। সারাজীবন দেশের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করা এই মহিয়সী নারী নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে এ জাতিকে চিরঋণী করে গেলেন। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর অবদান এর স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলার জনগণ তাঁকে বঙ্গমাতা উপাধিতে ভুষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতা যেমন আলোকবর্তিকা। তেমনি আমাদের স্বাধীনতা ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর অবদান অনন্য, অবিস্মরনীয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা হলে অবিচ্ছেদ্যভাবে বঙ্গমাতার অবদান ভেসে উঠে।
লেখক : প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।