বঙ্গমাতা : বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা, সংকটের সঙ্গী

রাশেদ রউফ | সোমবার , ৮ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর নাম বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর রেণু, আর আমাদের বঙ্গমাতা। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রভাবশালী মহীয়সী নারী। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সংকটের সঙ্গী, জীবনের চালিকাশক্তি। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ছিলেন না; ছিলেন বন্ধু, পরামর্শক, সহায়ক ও সকল প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর যে তিনটি বই আমরা পেলাম, দেখা গেলো সেই বই লেখার নেপথ্যেও ছিলেন বঙ্গমাতা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।” সে প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘…আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর তুলনা করা যায় না। তিনি বাঙালি জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। এমনকি দলের নেতা না হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তখন তিনি সাহসী ও বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতিতে স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব হতো, যদি বেগম মুজিব তার সঙ্গে না থাকতেন।
বেগম মুজিবের আরেকটি সিদ্ধান্তকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করেন ইতিহাসবিদরা। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধু তার দলের সদস্যদেরও বিভিন্ন কথা তাঁর মনে একধরনের বিভ্রান্তি ও চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই কোমলমতি, স্নেহময়ী নারী তখন সময়ের প্রয়োজনে হয়েছেন কঠিন ও বিচক্ষণ। এরূপ একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ তিনি সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বক্তব্য কী হবে, সে সম্বন্ধে এর পূর্বে নানাজন তাঁকে লিখিত-অলিখিত নানা পরামর্শ দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও একটানা ৩৬ ঘণ্টার এক বৈঠকে মিলিত হয় মর্মে জানা যায়। কিন্তু বৈঠকে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত না হওয়ায় উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা আবশ্যক তাই বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর দায়িত্ব তুলে নেন। এক্ষেত্রে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে… অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে … তুমি নিজে যে ভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে। (সূত্র : শেখ হাসিনা ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ: কিছু স্মৃতি’, আবদুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইতিহাস ও তত্ত্ব, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০১৪)। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রবন্ধে লিখেছেন, “একদিন ৩২ নম্বরে এই লাইব্রেরি কক্ষে বঙ্গবন্ধু ভাবীকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘একজন নারী ইচ্ছে করলে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারতেন’। আর জবাবে আমি বলেছিলাম, “তিনি যদি আপনার জীবন পাল্টে দিতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসও সেদিন পাল্টে যেতো। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিন যেমন শেখ মুজিবের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে, তেমনি হবে মুজিবের পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছারও। তাঁকে ছাড়া বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস রবে অসম্পূর্ণ।” আসলে তাঁর মতো ত্যাগী, উদার, সাহসী মানুষ বিরল। বাঙালি জাতির জীবনে তিনি এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে তিনি ছিলেন ‘অন্যতম অগ্রদূত’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ‘বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তাকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে কারাবন্দি স্বামীর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মাঝেও তিনি অসীম ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
বঙ্গবন্ধুর সেই সংগ্রামী জীবনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ছিলেন ছায়াসঙ্গী। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, তার অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা করাসহ প্রতিটি কাজে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, যার বিবরণ বিভিন্ন সময়ে তাদের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা উঠে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা। বাবার নেতৃত্বের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন আমার মা।’ তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সর্বক্ষণের সহযোগী ও অনুপ্রেরণাদায়ী এই মহীয়সী নারীকে একদিকে যেমন সাধারণ একজন বাঙালি নারীর মত স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে তিনি রেখে গেছেন ‘অনন্য ভূমিকা’।
প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। তাঁর ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থটিতে একটি অধ্যায় লিখেছেন বেগম মুজিবকে নিয়ে। ‘প্রেরণাদায়িনী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ শীর্ষক অধ্যায়টিতে লেখক জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর পত্নী ফজিলাতুন্নেছার সর্বত্যাগী, সাহসী ভূমিকার কথা। লিখেছেন বেগম মুজিবের সাধারণ জীবনের অসাধারণ কথা। সহজ-সরল বাঙালি গৃহিণীর অপরূপ কথা। এবিএম মূসা লিখছেন : ‘দেখেছি ৩২ নম্বর বাড়ির দোতলায় বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে যাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছেন, মুখে পান। হাতের ওপরে চুন। কোনোদিন সকালবেলা বাড়ির পেছনের সিঁড়িটি বেয়ে দোতলায় শোবার ঘরের দরজায় উঁকি মারতেই বলতেন, ‘আসুন, পান খান।’ আমাকে যখন পানটি এগিয়ে দিতেন, পাশে আধশোয়া মুজিব ভাই পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে পাইপ ধরা মুখের ফাঁক দিয়ে মৃদু হাসতেন। আমার দিকে তাকিয়ে সুর করে বলতেন, ‘বাটা ভরে পান দেব গাল ভরে খেয়ো’।’
আসলে বঙ্গমাতা যেমন সাধারণ চলাফেরায় অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত ত্যাগী। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে ত্যাগের কথা লিখেছেন এভাবে : রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়”(পৃ. ১২৬)। আর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘সে [রেণু] তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে’ (পৃ. ১৪৬)। আসলে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। ফলে তাঁকে ফেলে কোথাও তিনি যেতেন না। এমনকি মৃত্যুকালেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়-“জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে ছিলেন। যখন ঘাতকরা আমার বাবাকে হত্যা করল, তিনি তো বাঁচার আকুতি করেননি। তিনি বলেছেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।’ এভাবে নিজের জীবনটা উনি দিয়ে গেছেন। সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন।” (আমার মা: বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, ৮ আগস্ট, ২০১৬, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৮৬ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মা’কে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ)।
আমরা সহজেই বুঝতে পারি, শেখ মুজিব থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ না হলেও, তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল নারী। রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে পালন করেছেন দিশারীর ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গমাতার ৯২তম জন্মবার্ষিকী আজ
পরবর্তী নিবন্ধভোগ্যপণ্যের বাজারে চাপ