বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সাম্রাজ্যবাদের থাবা

ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

পূর্ব প্রকাশিতের পর
এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতির কারণে নিরুপায় হয়ে কি বঙ্গবন্ধু তাদের কাজে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় প্রশাসনে ৮০ ভাগ লোক ছিল কলাবোরেটর। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসই বঙ্গবন্ধুকে বার বার ঠকিয়েছে। বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে আমলাতন্ত্র বাতিল করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে প্রশাসন তুলে দেয়ার লক্ষ্যে বাকশাল গঠন করে গভর্নর মনোনয়নে আমলাদের ক্ষিপ্ত হওয়াটা, বিক্ষুব্ধ হওয়া বা সতর্ক হবার ব্যাপারটি ছিল খুবই প্রণিধান যোগ্য। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঝে ভারত বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা, রক্ষী বাহিনী তৈরী, পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর জওয়ানদের ভারত বিদ্বেষ পোষণ, মুসলিম বিশ্বের প্রতি অনুরক্ত হওয়া, সেনাবাহিনীকে দুর্বল ও পরনির্ভরশীল করার গোপন প্রচারণায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ইত্যাদিতে মুজিব বিরোধী মনোভাব গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। সেনাবাহিনীর বেতন কাঠামো নিয়ে মুজিব সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার চক্রান্ত সেনাবাহিনীর ক্ষোভকে আগুনে ঘৃতাহুতির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল রক্ষী বাহিনীকে দেয়া সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত মিথ্যে ধারণা। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কে.এম শফিউল্লাহকে নিয়োগ দেয়া নিয়ে জিয়াউর রহমানের ভেতরে ভেতরে তীব্র ক্ষুব্ধ হওয়া অথচ প্রকাশ না করা ইত্যাদি এমন কি সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মুজিব হত্যাকাণ্ডের একটি অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে যায় যা ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সেনাবাহিনী, রক্ষী বাহিনী, একে অপরের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি, বিক্ষোভ, দলাদলি, কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সব মিলিয়ে এমন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যা সামাল দেয়া মুজিব সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনীর পরিপূর্ণ বিভেদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লো। অনেকেই জিয়াউর রহমানকে এই বিভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধু একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলেণ, জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখনো ছেলে মানুষ। দেশের অবস্থা ভালো না। বঙ্গবন্ধুর ৩২নং ধানমন্ডির বাসায় অনেকের উপস্থিতিতে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, স্যার আমার বুক বিদ্ধ না করে বুলেট আপনার গায়ে লাগতে পারবে না। অনেকেই মন্তব্য করেছেন জিয়াউর রহমানের এইসব কথাগুলো ছিল নিছক ভাওতা।
অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপগুলোকে ব্যর্থ করার জন্য পাকিপন্থী ব্যবসায়ীরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে এবং পুরো দেশে দুর্নীতি বাতাসের গতিতে বাড়তে শুরু করে। কৃত্রিম পণ্য সংকটে দেশ নিমজ্জিত হয়। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপের উপর শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
আবার ফিরে আসি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরে। বিশ্বের বড় বড় নেতা আলেন্দে, থিউ সাম্পান এর মতো কিসিঞ্জারের নিকট মুজিব ছিলেন ঘৃণিত ব্যক্তি। পাকিস্তান রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে কিসিঞ্জার এতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে যে ১৯ মি: এর বাংলাদেশ সফরের পর পরই কুপ্ল্যানিং সেল এর সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের চুক্তি হয়। মূলত পাকিস্তানের পরাজয় মার্কিন প্রশাসন কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারছিল না। কিসিঞ্জার অবশ্যই একজন ভিনডিকটিভ প্রকৃতির লোক ছিলেন। শোষিতের পক্ষে কমনওয়েলথে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়াতে কিসিঞ্জার আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ভিয়েতনামে বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি, পিএলওকে স্বীকৃতি, ইসরাইলকে প্রত্যাখ্যান সবকিছুতে কিসিঞ্জার মনে করলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিনী নীতি চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন। বঙ্গবন্ধুকে জ্বলন্ত থ্রেট (নঁৎহহরহম ঃযৎবধঃ) মনে করা হলো। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর শোষিতের পক্ষে ভাষণের পর ফিডেল ফ্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আজ থেকে একটা বুলেট অহরহ তোমার পেছনে নেবে। এর পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে সাম্রাজ্যবাদ চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দেন। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা চাইলেন। সিআইএ বঙ্গবন্ধু এই পদক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখলো আর পরিকল্পনা মাফিক এগোতে লাগলো। সাম্রাজ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদই। ওরা করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। ১৯৭১ সালে নয়াদিল্লীতে যে ফিলিপ চেরী সিআইএ প্রধান ছিল সেই ফিলীপ চেরী ১৯৭৪ সালে ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন এবং মুজিব হত্যার পরিকল্পনা সিআইএ প্রধান হিসেবে বিস্তৃত করতে থাকে। কিসিঞ্জার তাঁকে মুজিব হত্যার গ্রীণ সিগন্যাল দিয়ে দেয়। বাংলাদেশে সিআইএ অনেক বাঘা বাঘা লোকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সহজভাবে করে তোলে। সিআইএ তাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তি মাহবুব আলম চাষীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে এবং মুজিব হত্যা পরিকল্পনার পর এই যোগাযোগ সম্পর্ক আরো গভীর হয়। এভাবে মোস্তাক সিআইএ এর বিশ্বস্ত লোক হয়ে উঠে এবং সিআইএ মুজিবকে হত্যা করে সফল হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড একটি পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। খুনী রশিদ এক সাক্ষাৎকালে স্বীকার করেছেন, তারা চেয়েছিলো বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম এই হত্যাকান্ডকে ব্যক্তিগত দ্বন্ধ বলে চালাবার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে এগুলো সব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই হত্যাকান্ডটি সরাসরি পাকিস্তানের প্রতিশোধ এবং হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত আক্রোশ বা নিজের পরাজয়ের প্রতিশোধ। হেনরি কিসিঞ্জার পৃথিবীতে তিনজন ব্যক্তিকে শত্রু মনে করতেন। তাঁরা হলেন- চিলির আলেন্দে, খেমারের থিউ সাম্পান ও বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু। স্বাভাবিকভাবে শত্রু নিধন তাঁর পরিকল্পনাতে ভেসে উঠেছে। কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি স্যান্ডার্স, গ্রিফিন, ফিলিপ চেরী যথাক্রমে পেন্টাগন, কোলকাতা ও বাংলাদেশে অবস্থান করে দ্রুতগতিতে হত্যাকান্ড বাস্তবায়ন করে। হতে পারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ গোলাম মোস্তফার ছেলের সঙ্গে ডালিমের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক, সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করে রক্ষী বাহিনী গঠন, খোন্দকার মোস্তাক আহমদের উচ্চাভিলাষ, জিয়াউর রহমানের “তোরা জুনিয়র অফিসাররা কাজটি করলে আমার কোন আপত্তি নেই মৌন সম্মতি”, ১৯৭৪ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মারাত্মক দুর্নীতি, আরো বহুবিধ কারণ ঐ সাম্রাজ্যবাদের থাবার সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে যেতেও পারে।
খোন্দকার মোস্তাকের ইনডেমিনিটি, জিয়াউর রহমানের সেই ইনডেমিনিট আদেশ আইনে পরিণত করা খুনী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে প্রশাসনে প্রতিষ্ঠিত করা, স্বৈরাচার এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করা, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদে ইত্যাদি ইসলামী রাষ্ট্র বানানোর সমীকরণে পড়ে এটা নিঃসন্দেহে সত্যি। কিন্তু একমাত্র নেত্রী, বিশ্বনেতা শেখ হাসিনা এর পক্ষে সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অতি কষ্টে অর্জিত দেশকে মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে রক্ষা করে আধুনিক দেশে পরিণত করার পদক্ষেপ নিতে। বঙ্গবন্ধুর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই প্রতীতি এখন জমতে শুরু করেছে জনগণের অভ্যন্তরে। তারপরও বলবো মৌলবাদ ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বসে নেই চক্রান্তের জাল তারা কিন্তু বুনেই চলেছে। জনগণকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। নেত্রীকে আরো বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। হেনরি কিসিঞ্জারের প্রেতাত্মারা বসে নেই। এরা যে কোন মূহুর্তে উদ্ধত ফনা বিস্তার করতে পারে। তাই সাবধান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, এর বন্ধু পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রতিশোধ নিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব স্তব্ধ করে দিয়েছে, মৌলবাদ-ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশলীল চক্র শাসন ক্ষমতায় এসে দেশে সাম্প্রদায়িকতার অশালীন বীজ রোপণ করেছে যা আজো সদম্ভে বিরাজমান, বন্ধু রাষ্ট্র ভারত বিদ্বেষী মনোভাবকে শাণিত করেছে, কিসিঞ্জার খুনীতে টগ্‌বগ হয়ে বিস্তর স্যাম্পেন পান করেছে, জিয়াউর রহমান মিলিটারী পোশাক ত্যাগ করে রাতারাতি রাজণীতিবিদ হয়ে গেলেন, পাকিশক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পেতে পাকি প্রেমিকের সংখ্যা বেড়েই চললো, সংবিধানের চার স্তম্ভের মূলে কুঠারাঘাত করা হলো আর বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। এজন্যই কি ত্রিশ লক্ষ শহীদ আত্মাহুতি এবং দু’লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল। ভাগ্যিস শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে ছিলেন। না হলে এদেশ যে কোথায় যেত ভাবলেও গা হাত শিহড়ি উঠে। খুনীরা কেন ভারতের স্বাধীনতা দিবসকে বেছে নিল এ বিষয়ে পরে লিখার ইচ্ছে রইলো।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা চ.বি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধওয়াকফ সম্পত্তি প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে চট্টগ্রাম