ওয়াকফ সম্পত্তি প্রসঙ্গে

জেনে নিন আপনার যত অধিকার

জিয়া হাবীব আহসান | মঙ্গলবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

প্রশ্ন : ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তানান্তর তথা ক্রয় বিক্রয় করা যায় কিনা?
উত্তর : ওয়াকফ এর আইনগত অর্থ হলো সম্পত্তির মূল বিষয়বস্তুকে বন্ধ করে দিয়ে এর আয়কে কোন পবিত্র উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা। ইসলাম ধর্মেও যে কোন ধর্মপ্রাণ মুসলমান কর্তৃক ধর্মীয় ও দাতব্য উদ্দেশ্যে চিরতরে সম্পত্তি উৎসর্গ করাকে ওয়াকফ বলে। ওয়াকফকৃত সম্পত্তি কারো নিকট বিক্রয় হস্তান্তর করা চলে না কিংবা একে হেবা বা মিরাসের (ওয়ারিশী) বিষয়বস্তু করা যায় না। পাঁচ বৎসরের অধিক সময়ের জন্য ইজারার মাধ্যমে হস্তান্তরও বৈধ হবে না। শুধু মাত্র প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে মোতোয়াল্লী সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ সম্পত্তি অথবা এর কোনও অংশ বিক্রয় করতে, রেহেন দিতে বা বিনিময় করতে পারেন। জনস্বার্থে অথবা ওয়াকিফের পরিবারের স্বার্থে, যে কোনও উদ্দেশ্যেই ওয়াকফ সৃষ্টি হোক না কেন, এ বিধি নিষেধ সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য। মোতোওয়াল্লী বা রিসিভার ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তরের অনুমতির জন্য প্রশাসকের নিকট আবেদন করলে প্রশাসক যেরূপ উপযুক্ত মনে করবেন, সেরূপ তদান্তানুষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের নোটিশ প্রদানের পর, বক্তব্য শ্রবন পূর্বক স্বীয় বিবেচনা মতে যেরূপ শর্ত আরোপ করবেন সেরূপ শর্তে উক্ত হস্তান্তর অনুমোদন করতে পারবেন।
প্রশ্ন : কখন ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রয়, হস্তান্তরের অনুমতি পাওয়া যায় ?
উত্তর : ওয়াকফ সম্পত্তি উন্নয়নের জন্য ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তানান্তর বিক্রয় করা যায়। এ- ব্যাপারে ওয়াকফ (সম্পত্তি হস্তানান্তর ও উন্নয়ন) বিশেষ বিধান আইন, ২০১৩ সনের ৫নং আইন প্রযোজ্য হবে।এই আইনের বিধি লংঘন করলে তা ফৌজদারি অপরাধ যা আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য। এই আইন ভঙ্গের শাস্তি অনুর্ধ ৩(তিন) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
প্রশ্ন : ওয়াকফ কত প্রকার হতে পারে?
উত্তর : ওয়াকফ দুই প্রকারের হতে পারে। একটি ‘ওয়াকফ ফি ছাবিলিল্লাহ’ এবং অপরটি ‘ওয়াকফ আল- আওলাদ’। ওয়াকফকৃত সম্পত্তির আয়ের সম্পূর্ন অংশ নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বরাবরে অথবা অন্য যেরূপ কাজের জন্য ওয়াকফ সৃজন করা হয়েছে, তার জন্য ব্যয় হবে তা হচ্ছে, ওয়াকফ ফি-ছাবিলিল্লাহ’। ওয়াকফকৃত সম্পত্তির আয়ের কোন অংশ উদ্ধৃত্ত থাকলে তা ওয়াকফ প্রতিষ্ঠাতা বা তদীয় পরিবারের সদস্যগণই ভোগ করবেন এরূপ হলে তা হবে ্তওয়াকফ আল-আওলাদ বা আলাল- আওলাদ’।
প্রশ্নঃ ওয়াকিফ এবং মোতোয়াল্লীর মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তরঃ ওয়াকফ সৃষ্টিকারী যে কোন ব্যক্তিই ওয়াকিফ। ওয়াকফকৃত ভূ-সম্পত্তিতে ওয়াকিফের মালিকানার অবসান ঘটে এবং উক্ত সম্পত্তি আল্লাহতালার পরোক্ষ মালিকানা দ্বারা আটক হওয়া বুঝায়। যার দ্বারা ওয়াকফ সম্পত্তির আয় মানবজাতির কল্যানে নিয়োগ হবে এবং সে সম্পত্তি বিক্রয় কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা হস্তান্তর হবে না। প্রাপ্ত বয়স্ক (১৮ বৎসর) এবং সুস্থ মস্তিষ্ক যে কেউ ওয়াকফ করতে পারেন। ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপকই হলেন মোতোয়াল্লী । অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষে ওয়াকফ সম্পত্তি দেখাশুনা, ব্যবস্থাপনা, রক্ষনাবেক্ষন বা পরিচালনা করেন তিনিই মোতোয়াল্লী । ওয়াকফ সম্পত্তিতে মোতোয়াল্লী র কোন অধিকার নেই। তিনি কেবল এর তত্ত্বাবধায়ক বা ম্যানেজার হন মাত্র।
প্রশ্ন : মোতোয়াল্লী কে নিয়োগ দেন?
উত্তর : ওয়াকিফ স্বয়ং নিজেকেই প্রথম মোতোয়াল্লী, আজীবন মোতোয়াল্লী নিযুক্ত করতে পারেন, অন্যকেও পারেন। ভবিষ্যৎ মোতোয়াল্লীর দিক নির্দেশনাও ওয়াকফ দলিলে উল্লেখ করতে পারেন। এ-নিয়ে ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি হলে, এ পদ শূন্য হলে ওয়াকফ প্রশাসক ও আদালত আইনানুযায়ী মোতোয়াল্লী নিয়োগ দিতেপারেন। ওয়াকফ সৃষ্টিকারী মৌখিকভাবে বা কোন দলিল বা দস্তাবেজের অধীনে অথবা কোন যোগ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত কোন ব্যক্তি ওয়াকফের মোতোয়াল্লীরূপে পরিগনিত হবেন। মোতোয়াল্লী নিয়োগের পূর্বে প্রশাসক প্রথমেই নির্ধারন করবেন যে, তর্কিত সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি কিনা। জেলা জজ মোতোয়াল্লী নিয়োগের আবেদন গ্রহণ করতে পারেন। জেলা জজ অতিরিক্ত জেলা জজকে দায়িত্ব দিলে তিনিও মোতোয়াল্লী নিয়োগ করতে পারেন। অনিশ্চয়তার জন্য ওয়াকফ বাতিল হয়। তর্কিত সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরই কেবল প্রশাসক মোতোয়াল্লী নিয়োগ দিতে পারেন। ওয়াকিফ নিজে, ওয়াকিফের এঙিকিউটর যদি থাকে, তিনি মোতায়াল্লী নিয়োগ দিতে পারেন। মোতোয়াল্লী পদ পুরুষান ক্রমিক নয়। কিন্তু রেওয়াজ অনুসারে পদটি পুরুষানুক্রমিক হতে পারে। মোতোয়াল্লী নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তথ্য গোপন ও ওয়াকফ প্রশাসনের যোগসাজশে মোতোয়াল্লী নিয়োগ বেআইনী ও অবৈধ।
প্রশ্নঃ বিরোধীয় সম্পত্তি ওয়াকফ করা যায় কিনা?
উত্তরঃ ওয়াকিফকে ওয়াকফকৃত সম্পত্তির বৈধ মালিক হতে হবে অর্থাৎ যে সম্পত্তি ওয়াকফ করা হবে তার স্বত্ব- স্বামীত্ব ওয়াকফ করার সময়ে ওয়াকিফের থাকা চাই। ওয়াকফ কালে কোন ব্যক্তির ওয়াকফকৃত সম্পত্তিটি আদান প্রদান এর ক্ষমতা থাকতে হবে। ওয়াকফ দ্বারা যদি উত্তরাধিকারদেরকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্য হয় তাহলে ঐ ওয়াকফ কার্যকরী হবে না। তবে ওয়াকিফ যদি ওয়াকফকৃত সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী নাও হয় এবং সে যদি ওয়াকফ করে এবং মালিক কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়, তাহলে ঐ ওয়াকফ অবৈধ হবে না। ওয়াকিফ কর্তৃক কোন সম্পত্তি ক্রয়ের চুক্তি হলেও সে ঐ সম্পত্তি ওয়াকফ করতে পারে, যদি শেষ পর্যন্ত সে ঐ সম্পত্তি ক্রয় করে। কোন সম্পত্তির অবিভক্ত অংশ (মুশা) কোন মসজিদ বা সমাধির অনুকূলে ওয়াকফ করা যায় না। একবার যদি কার্যকরীভাবে সম্পাদিত হয় তাহলে তা প্রত্যাহার কিংবা বাতিল করা যাবে না। ওয়াকফ সৃষ্টির জন্য সম্পত্তি নিস্কন্টক হতে হবে। মামলার সম্পত্তি বা বিষয়বস্তু ওয়াকফ করা বৈধ নহে। যে সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারন নিয়ে আদালতে মামলা বিচারাধীন সে সম্পত্তি দিয়ে ওয়াকফ সৃষ্টি করা ঠিক নহে। এধরনের ওয়াকফ এর দ্বারা মামলা মোকদ্দমা সৃষ্টি হয় মাত্র। একশত টাকা কিংবা তদূর্ধ্ব মূল্যের কোন সম্পত্তি ওয়াকফ করা হলে তা অবশ্যই রেজিষ্টার্ড দলিল মূলে করতে হবে। এমনকি যদি ওয়াকিফ স্বয়ং একমাত্র মোতোয়াল্লী ও হয় তা হলেও তা রেজিষ্ট্রি করতে হবে। রেজিষ্ট্রেশন আইন অনুযায়ী এটা বাধ্যতামূলক।
প্রশ্নঃ ওয়াকফ সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশকারী এবং দুস্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়?
উত্তরঃ যদি কোন ওয়াকফ সম্পত্তিতে শরিকদার, অথবা একক স্বত্বভোগী, অথবা এতে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অপর কোন ব্যক্তি অথবা কোন আগুন্তুক কোন উপদ্রব সৃষ্টি করে, অথবা শান্তিপূর্নভাবে ওয়াকফের অথবা কোন প্রকারে ব্যবস্থাপনায়, তৎসংলগ্ন কোন প্রতিষ্ঠানে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, শান্তি পূর্ন দখলে বাধা দান করে, অথবা ঐ সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশ করে, তবে প্রশাসক ডেপুটি কমিশনারের নিকট দরখাস্ত করবেন। অতঃপর ডেপুটি কমিশনার উক্ত অনধিকার প্রবেশকারীকে উৎখাৎ করে দেবেন অথবা উৎপাত বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক উৎখাতকৃত ব্যক্তি উৎখাতের দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে ঐ উৎখাতের বিরুদ্ধে জেলা জজের নিকট আপীল করতে পারবেন। তখন জেলা জজের আদেশ চূড়ান্ত গন্য হবে। এইখানে লক্ষ্যনীয় যে, কোন ব্যক্তিকে উচ্ছেদের দরখাস্তের সত্যতা যাচাই করা ওয়াকফ প্রশাসকের দায়িত্ব। তিনি এব্যাপারে প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে শোকজ করবেন এবং মোতোয়াল্লীর দরখাস্তের সত্যতা যাচাই করবেন। – দেওয়ানী আদালতে এতদ সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন থাকলে সাবজুডিস মেটারে হস্তক্ষেপ করবেন না। কোন ব্যক্তিকে উচ্ছেদের দরখাস্ত ওয়াকফ প্রশাসক নামঞ্জুর করে দিতে পারেন। উক্ত না মঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ নেই।
প্রশ্নঃ ওয়াকফ সম্পত্তির হিসাব কে নেবেন?
উত্তরঃ প্রত্যেক বৎসর ১৫ই জুলাইর পূর্বে ওয়াকফের প্রত্যেক মোতাওয়াল্লী একটি সঠিক পূনাঙ্গ হিসাব বিবরনী যথা নিয়মে প্রস্তুত করে প্রশাসকের নিকট দাখিল করবেন। এছাড়াও প্রশাসক চাওয়া মাত্র মোতোয়াল্লী উক্ত হিসাব প্রদানে বাধ্য। আদালতও মোতোয়াল্লীকে হিসাব দাখিলের নিদের্শ দিতে পারেন।
প্রশ্নঃ মোতোয়াল্লী কখন শাস্তিভোগ করেন?
উত্তরঃ মোতোয়াল্লী তাঁর দায়িত্ব সঠিক ও যথাযথভাবে পালন করছেন কিনা দেখার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে প্রশাসকের উপর। মোতোয়াল্লী ওয়াকফ অধ্যাদেশের অধীনে আইন সঙ্গতভাবে তাঁর যে কাজ করতে হবে তা করতে ব্যর্থ হন তবে তিনি ২,০০০/- (দুই হাজার) টাকা পর্যন্ত জরিমানা অনাদায়ে ০৬ (ছয়) মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড ভোগ করবেন। কোন তদন্তের ভিত্তিতে যদি দেখা যায় যে একজন মোতোয়াল্লী কে অপসারন করা প্রয়োজন, তবে প্রশাসক তা করতে পারেন।
প্রশ্নঃ ওয়াকফের তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক কিনা ?
উত্তরঃ মোতোয়াল্লী ওয়াকফ সম্পত্তি প্রশাসকের অফিসে তালিকাভুক্ত করতে আইনত বাধ্য। তবে ওয়াকফ- এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তি অনুরূপ তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। ওয়াকফ সম্পত্তি ই.সি ভুক্ত না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ এবং আমার পিতার স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সাম্রাজ্যবাদের থাবা