বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ আর জহুর আহমদ হলেন ‘আর্টিস্ট অব পলিটিক্স’

মোস্তফা কামাল পাশা | রবিবার , ৪ জুলাই, ২০২১ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

মৃত্যুর পর দাফনশেষে আচকান-পাঞ্জাবির পকেটে মিলে দশ টাকার একটি নোট। সাথে বক্তৃতার পয়েন্টের কিছু টুকে রাখা খুচরো কাগজ। শূন্যহাতে আগমন শূন্য রেখেই প্রস্থান! বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, জমা টাকা নেই। বিষয় আশয়ও শূন্য! তিনি চট্টগ্রামের গণ মানুষের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তবতা। সন্দেহ বাতিক থাকলে কেউ সরেজমিন অনুসন্ধান করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক সহচর ও সরকারের দাপুটে মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরী এমনই একজন ক্ষণজন্মা গণ মানুষের হারিয়ে যাওয়া নেতা।
বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন ‘পোয়েট অব পলিটিক্স আর জহুর চৌধুরী হলেন ‘আর্টিস্ট অব পলিটিক্স। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সম্পর্কটা ছিল সবচে’ মধুর। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ, দু’জন কাছেই ছিলেন। তাঁদের সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে রাজনৈতিক হিউমার প্রচুর। মুছে যাওয়ার আগে চয়ন করে কোন গবেষক গ্রন্থিত করবেন, চলমান বাস্তবতায় সম্ভাবনা অবাস্তব। হলে আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ হতো। ক্ষুধাতুর রাজনীতি গণ মানুষের কল্যাণের নতুন আলোর উৎস খুঁজে পেত। নগরীর উপকন্ঠ কাট্টলিতে জন্মানো ক্ষিণতনু মানুষটি ছিলেন প্রচণ্ড পরাক্রমশালী! দেশ, শ্রমজীবী ও গণমানুষের কল্যাণে জীবনের সর্বসুখ বিলিয়ে দেয়া এতবড় মাপের রাজনীতিক দেশ খুব কম পেয়েছে? বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর রাজনৈতিক রসায়ন নিবিড় ও রসালো হবে, কল্পনা করতেও অবিশ্বাস্য লাগে। বঙ্গবন্ধুর হলিউড ছবির নায়কোচিত দেহ সৌষ্ঠবের সাথে চৌধুরীর ক্ষিণতনু পাটকাঠি মিলাতেও কষ্ট! কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম এক ঘরানার রাজনীতি দু’জনের। মুসলিম লীগে শুরু আওয়ামী লীগে ইতি! পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায়ও দু’জন সামনে-বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাই! মাঝখানে সামান্য ফাঁক। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ নামে নিষ্ঠুরতম গণহত্যার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে আটক করে। আগেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘোষণা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে গোপন ওয়ারলেস বার্তায় পাঠিয়ে দেন। চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদন করে জাতিকে মুক্তির ঠিকানায় পৌঁছে দেন। বঙ্গবন্ধুর আটকাবস্থায় প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ফাঁকটা বাদ দিলে দু’জনের জীবন এক ফুলের দু’পাঁপড়ি।
স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে কোতোয়ালী-পাঁচলাইশ আসনে জয়ী হয়ে চৌধুরী বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী। আগে ছিলেন শ্রমমন্ত্রী। এর আগে চট্টগ্রামের ২৩ নম্বর রেস্ট হাউসে ছিল শহর আওয়ামী লীগ তথা জনাব চৌধুরীর স্থায়ী আস্তানা। আজিজ কোম্পানি, কর্ণফুলী পেপার মিল, দাউদ, আমিন জুট মিল, বার্মা অয়েল, সিটি ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক ইউনিয়নসহ চট্টগ্রামের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তিনিই অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। কলকাতা ডকইয়ার্ড শ্রমিক নেতা হিসাবে বৃটিশ আমলেই হাত পাকিয়েছেন। শহর আওয়ামী লীগের মূল কাণ্ডারীর পাশাপাশি শ্রমিক রাজনীতিতেও সার্বক্ষণিক যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সবকিছুই জানতেন। তিনি জানেন, তাঁর বন্ধু জহুর মিয়াকে কেনা যায়না, শ্রমিকের পাওনা প্রশ্নে পাকিস্তানি বিখ্যাত শিল্প মালিকরা রেস্ট হাউসে প্রকাশ্যে তাঁর সরু পা মালিশ করেও ন্যূনতম সুবিধা পাবেনা। এর বহু চমকপ্রদ নজির তাঁর ভক্ত ও কর্মী গোফরান গাজী, হারিস চৌধুরীসহ অনেকের মুখ হয়ে রাজনীতির রসালো ডিশ।
সাহস, সততায় নিরাপোষ তিনি। স্বাধীনতার পর দলের সিনিয়র নেতা খোন্দকার মোস্তাক, মিজান চৌধুরীসহ আরো ক’জন তাঁর পিছু লাগে। মোস্তাককে মোটেই সহ্য করতেন না। বঙ্গবন্ধুর সামনেই দুর্ব্যবহার করতেন। বঙ্গবন্ধু থামাতে গেলে বলতেন, ‘লিডার, এই বেডা দেশ ও দলের বারোটা বাজাবে’! শুনে বঙ্গবন্ধু দরাজ হাসিতে ফেটে পড়তেন। কখনো পকেটে টাকা থাকতোনা, থাকলেই উড়াতেন কর্মীদের জন্য। ষাট দশকের শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলনসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামে রেস্ট হাউসে নিয়মিত নেতা- কর্মীদের ভিড় থাকতো। আবার খাবার সময় সবাই পাত পেতে ফ্লোরে বসে খাচ্ছেন। রমজান মাসে প্রতিদিন সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ইফতার করতেন রেস্ট হাউসে। পা’জামা, পাঞ্জাবির উপর আচকান চাপানো ক্ষীণকায় মানুষটির স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের আভা সবাইকে টানতো। তাঁর লেখাপড়া ও সমকালীন গভীর রাজনীতি জ্ঞানও অবিশ্বাস্য। বক্তৃতায় অনর্গল গালিব, রুমি, ফেরদৌসী, হাফিজের উদ্ধৃতি টানতেন। কোরান-হাদিস জ্ঞান সাবলীল ও নির্ভুল। শিল্প- সাহিত্যেও ছিল বিশাল দখল।
শ্রমিকদের পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। দলের জন্ম থেকে আওয়ামী লীগের মাঠের লড়াকু কর্মী। প্রিয় বন্ধু আরেক কিংবদন্তী এম এ আজিজের সাথে সাংগঠনিক প্রতিযোগিতা তীব্র হলেও পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল অনন্য। সীমিত শব্দে তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞের অল্পই তুলে আনা সম্ভব নয়। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের পোক্ত ভিত গড়তে তাঁর বহুমুখী অবদান এ’যুগের খুব কম নেতা-কর্মীই জানেন। জহুর-আজিজসহ নিবেদিত নেতাদের কর্ম ও জীবন নিয়ে আলাদা গবেষণা ও আর্কাইভ গড়া উচিত। নগর নেতৃত্ব দলকে গণমুখী করতে কাজটা হাতে নিতে পারে। নগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর খাতিরে লিখতে গিয়ে তথ্য সঙ্কটে পড়ি বারবার। তাঁর আরেক ছেলে বিজিএমইএ নেতা হেলালউদ্দিন চৌধুরী তুফানের সহায়তায় বিশাল ফরমায়েসী কিতাব বানিয়েছে এক জীবনীকার। দরকারি তথ্যের চে’ এতে মেদ বেশি। উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট, মাহতাব ভাই, চৌধুরীর ছোট ছেলে জসীম উদ্দীন চৌধুরীসহ আরো ক’জনের তথ্য সহযোগিতা নিতে হয়।
মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক আস্থাভাজন থাকার বিরল যোগ্যতা। মুজিব নগর সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে কুমিল্লার মুক্তাঞ্চলে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করেন ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সংক্ষিপ্ত দু’মেয়াদেই প্রভাবশালী পূর্ণমন্ত্রী তিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বকালীন অসুস্থ হয়ে সাবেক পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠাতে চাইলে বলেন, ‘আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিলে চিকিৎসা সেবার উপর জনগণ আস্থা রাখবে কেন? এমন হয়না’। কিছুদিন পর পিজিতেই ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই অনন্তলোকে পাড়ি জমান তিনি। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম এসে নিজেই প্রিয় বন্ধু ও সহকর্মীকে দামপাড়ার পল্টন রোডের কবরে সমায়িত করেন। মৃত্যুর পর তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে দশ টাকার উদ্ধৃত ব্যাঙ্কনোটটি পাওয়া যায়। এটাই তাঁর জীবনের সঞ্চয়! প্রথম স্ত্রীর বাবার সূত্রে প্রাপ্ত পল্টন রোডের এক খন্ড জমিতে পুত্ররা ডেভলপার দিয়ে বহুতল ভবন করে বাস করেন এখন। রাজনীতির শুদ্ধতম মহান মানুষটির ত্যাগ ও আদর্শিক আলো সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মনন আলোকিত করুক, ৪৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এটাই আন্তরিক কামনা।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরও নিষেধাজ্ঞা