বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেশে উচ্চশিক্ষা কেমন হতো?

ড. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন | সোমবার , ২১ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। অধ্যাপক আবুল ফজল চট্টগ্রামের কাজির দেউড়িতে বসবাস করতেন। তাঁর বাসায় তখন কোনো টেলিফোন সংযোগ ছিল না। বাংলাদেশ বিমানের চট্টগ্রাম অফিসে তখন টেলিফোন ছিল। বঙ্গবন্ধু বিমান অফিসে ফোন করে বিনয়ের সাথে বলেছিলেন যেন সাহিত্যিক আবুল ফজল উনার সাথে কথা বলতে আসেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ পেয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল বিমান অফিসে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু আনন্দের সাথে সাহিত্যিক আবুল ফজলকে বলেছিলেন আমি আপনাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দিতে চাই এবং আপনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করলে আমি কৃতার্থ হবো। আমরা সবাই সাহিত্যিক আবুল ফজলের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে অবগত আছি। পণ্ডিত ব্যক্তিকে কিভাবে সম্মান করতে হয় জাতির পিতা আমাদেরকে সেটি দেখিয়েছেন এবং আরো দেখিয়েছেন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের নেতৃত্ব বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের হাতেই থাকা উচিত। আমরা যারা জাতির পিতার আদর্শকে অনুসরণ করি, ধারণ করি এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা করি তাদের এই উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো শিক্ষা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন ও জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের যথাযথ স্থান। স্বভাবতই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায় পণ্ডিত ব্যক্তিদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে একটি জাতিকে উন্নত দেশে পরিণত করার একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। একটি দেশকে উন্নত দেশ তখনই বলা যায় যদি সেই দেশ প্রযুক্তিকে ধারণ করে ও গবেষণাকে লালন করে। একটি দেশে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকতে পারে তবে সেই দেশকে কখনোই আমরা উন্নত দেশ বলতে পারবো না; উন্নত দেশ সেই সমস্ত দেশকেই বলা যাবে, যেখানে দেশের ও জনগণের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যার সমাধানের জন্য দক্ষতা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, যে সমস্ত দেশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছে সেসমস্ত দেশ উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার একমাত্র কারখানা। প্রতিষ্ঠিত দক্ষ জনশক্তি ছাড়া একটি জাতি কখনোই তার উদ্ভাবনকে টেকসই করতে পারে না। আজকের পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা হয় সবচেয়ে বেশি সম্পদের অধিকারী এক একটি প্রতিষ্ঠান। তবে দুর্ভাগ্যবশত সেই সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা পুরো পৃথিবীব্যাপী একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো তারা কিভাবে শিল্প কারখানার চাহিদাকে মাথায় নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এমআইটিতে পুরো একটা রাস্তা রয়েছে যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির অফিস অবস্থিত। এই কোম্পানিগুলো তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এমআইটির বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতা চায় এবং এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি হয় যাকে আমরা বলি ইন্ডাস্ট্রি একাডেমীয়া কোলাবরেশন। এই কোলাবরেশনের মধ্য দিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি মেলবন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মেলবন্ধন জ্ঞানকে তার পরবর্তী স্তরে নিয়ে যায় যাকে আমরা জ্ঞানের উল্লম্ফন বলি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এক একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে এবং এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়সমুহ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধু এমআইটি নয় আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আমি উল্লেখ করতে চাই একটি হচ্ছে স্ট্যামফোর্ট ইউনিভার্সিটি আরেকটি হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে। সানফ্রান্সিসকোর স্যানজোন্সে সিলিকন ভ্যালি অবস্থিত। এই সিলিকন ভ্যালির দুই পাশে রয়েছে এই দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিয়ত মেধাবীদের সৃষ্টি করছে সিলিকন ভ্যালির দক্ষ জনশক্তির চাহিদা অনুযায়ী। এভাবে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। এভাবে বলা যায়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত এক একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। আজকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এক একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। কারণ তিনি ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট ছাত্রলীগের সম্মেলনে তাঁর বক্তব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশব্যাপী কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব কার হাতে তুলে দিবেন তারও একটা উদাহরণ আমাদের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরকম পাণ্ডিত্য সম্পন্ন নেতৃত্ব পেতো এবং কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হতো। আজকে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সামনে যে ভিশন ২০৪১ তুলে ধরেছেন তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বঙ্গবন্ধুর এই দিকনির্দেশনাগুলো আমাদের পালন করতে হবে এবং আমরা সেটা করতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করি। তাছাড়া জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাখাতের প্রতি বিশেষ নজর রেখে শিক্ষাখাতে অভূতপূর্ব অবদান রেখে চলছেন। গত এক দশকে শিক্ষার সর্বস্তরেই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষার এই ব্যাপক অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন অর্থনীতির ভিত্তিকেও করেছে মজবুত ও টেকসই, দেশকে বিশ্বের বুকে দিয়েছে পৃথক পরিচিতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি গঠনকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন। আধুনিক ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের প্রয়াসে দিনাতিপাতের সমানুপাতিক হারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে চলছেন।

লেখক: ফুলব্রাইট ভিজিটিং প্রফেসর, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, ডালাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রফেসর, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউক্রেন যুদ্ধ: অর্থনৈতিক দুর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয়
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল