ইতিহাস যেহেতু সময়ে সত্যসন্ধ প্রতিলিপি, তাই সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিত রচনা এই অর্থে জটিল যে, এই প্রক্রিয়ায় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, ভাবমার্গ সর্বোপরি বিবেক ও দায়বদ্ধতা উন্মোচিত হয়ে পড়ে স্পষ্টভাবে। বিষয়টি ওঠে এলো এই কারণে যে, মেধাবী প্রাবন্ধিক মো. সেকান্দর চৌধুরী’র সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা’র বিষয় নির্বাচন ও বিশ্লেষণ নিরিখে সমসাময়িক ও নিকট অতীতের বাস্তব অভিরেখ ও অভিঘাত এবং বিবেচনাপ্রসূত মূল্যায়ন।
ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষক স্বীয় অগ্রসর অবস্থান থেকেই যাবতীয় বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে তাঁর অন্তর্বীক্ষণ স্বচ্ছ ও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। স্বাধীনতা–দেশ বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার অনমনীয়–অটল অবস্থান।
গ্রন্থের নামকরণের মধ্যেই মো. সেকান্দর চৌধুরী’র মনোজগত ও ভাববৃত্তের গতিধারা ও প্রবণতা শনাক্ত করা যায়। তাঁর চেতনার ভরকেন্দ্রে রয়েছে শুভবোধ ও কল্যাণকামী এক আগামীর প্রত্যাশা। তাই অপব্যাখ্যার ধূসর ধোঁয়াশা সরিয়ে তিনি সত্যের সারবত্তা চিহ্নিত করেন। তাঁর এই সনিষ্ঠ অন্বেষণে নেপথ্যের কুশীলব ও তাদের ভূমিকাও তিনি বিশ্লেষণ করেন। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী আর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক মূল্যায়নে এই গ্রন্থ নিঃসন্দেহে একটি আবশ্যকীয় সহায়ক উপকরণ।
মো. সেকান্দর চৌধুরী একজন মনস্বী ও নিয়ত সৃষ্টিশীল ইতিহাসবেত্তা। তাঁর চর্চার বিষয়–বাংলা ও বাঙালি। বাংলার আর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক ইতিহাস। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ‘বাংলার মুসলিম সমাজ ও রাজনীতি ( ১৯২৫–১৯৪০)’ আর এম এ থিসিস ছিলো ‘ভারত বিভক্তি, সমাজ ও রাজনীতি ( ১৯৪৫–১৯৪৭)’। তিনি কেবল ইতিহাসের প্রচল অভিব্যক্তি বা ধারণার ওপর তার মনোযোগ ফোকাস করেননি, অনালোকিত বিষয় উদ্ঘাটনেও সেকান্দর চৌধুরীর তন্নিষ্ঠ অভিনিবেশ। একটা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যাক–প্রচলিত ধারণা যে, বঙ্গবন্ধু ৫২’ সালে জেলখানায় বন্দী ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা গৌণভাবে উপস্থাপন করেছেন কতিপয় একচোখা গবেষক। কিন্তু সেকান্দর চৌধুরী একজন প্রত্নসন্ধানীর নিষ্ঠায়, তথ্য–প্রমাণ সহযোগে মহান ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যুজ্জ্বল অবদান আলোকপাত করেছেন। আর একজন ইতিহাস রচয়িতার সেন্ট্রাল ডিসকোর্সও তাই–ই।
যদিও এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য অনতি–অতীত, কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে প্রাবন্ধিক আবহমান বাঙালির নৃ–তাত্ত্বিক, পুরাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় তার মতামত প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আদি বাংলার ঐতিহাসিক যোগসূত্রে। ঘটনা কার্যকরণ ও পরম্পরায় পাঠকের মানসভ্রমণ সম্পন্ন হয় বিশ্ববিজেতা আলেকজাণ্ডারের আমলের বাংলায়, কিংবা মাৎস্যন্যায় যুগে। পক্ষান্তরে রামমোহনের সতীদাহ প্রথা রোধ, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ, ডিরোজিও’র ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন, শিখা গোষ্ঠী, খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস–মুসলিম লীগের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম–ইত্যাকার বিষয় ও উল্লেখ্যযোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক উতরোলসমূহও আলোচিত হয়েছে।
কেবল স্বদেশীয় প্রসঙ্গ নয়, আন্তর্জাতিক যে মহা আলোড়ন, ভূ–মণ্ডলীয় রাজনীতি ওলট–পালট করে দিয়েছে তা–ও সম্পর্কসূত্রে গ্রথিত সেকান্দর চৌধুরীর মানসরাজ্যে। উদ্বৃতি দেওয়া যাক–
“১৯৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের চেতনা ও মানস যেমন গঠন করেছিলেন রুশো, ভলতেয়ার, বালজাক, তেমনি ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবেরও তাত্ত্বিক ছিলেন মার্কস–এঙ্গেলস। তাই দেশের এই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নতুন তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। (চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির)
বিভিন্ন তথ্য–প্রমাণ, উপাত্ত–পরিসংখ্যান সহযোগে তিনি তার মতামত ও মূল্যায়নের সারবত্তা প্রমাণ বা সিদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেই গ্রন্থের উপক্রমণিকায় বলেছেন,
“একজন ইতিহাস নিবিষ্ট মুক্তচিন্তক হিসেবে সত্যসন্ধান ও উদ্ঘাটনের মানসে, অগ্রসর ও কল্যাণকামী ভাবনার আলোকে আমার এই রচনা সমুদয়। আবাল্য লালিত মুক্তিযুদ্ধের ধ্যান–ধারণার পোষকরূপে, নিজস্ব দায়বদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতই এই প্রবন্ধগুলোর প্রেক্ষাপট।” (প্রারম্ভিক)
‘হাজার বছরের বাংলা–বাঙালির আত্মপরিচিতি–স্বাতন্ত্র্য, বিদ্রোহ, সংগ্রাম ও জাগরণী তার আরাধ্য টেঙট্। এই গবেষকের মানসরাজ্য কেবল রাজ–রাজড়ার জয়–পরাজয়, উত্থান–পতনের ধূসর তমসুক নয়, সমাজ ও রাজনীতির অবগুন্ঠিত চাপা পড়া ও অনালোকিত অধ্যায়ও একজন মনস্বী ও অগ্রগামী পর্যবেক্ষকের নিরীক্ষায় তিনি ঘটনার ধারাবাহিকতা, যোগসূত্র এবং প্রেক্ষিত উদ্ঘাটনেও ব্রতী।
মো. সেকান্দর চৌধুরী’র এ গ্রন্থের একটি ব্যতিক্রমী দিক হলো–উৎসর্গ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী’র উদ্দেশে উৎসর্গিত এই বই। ব্যাপারটি অভিনব, প্রতিক্রমী এবং যুক্তিযুক্তও বটে। কেননা বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচিতি ও অন্তঃসত্তা উদ্ঘাটনের সংগ্রামে দৈনিক আজাদীর বলিষ্ঠ ও সদর্থক ভূমিকা প্রশ্নাতীত। এই দৈনিক নিয়ে একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থে। লেখকের জবানি:
“বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিকে জাগ্রত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক হিসেবে দৈনিক আজাদীকে প্রকাশনার ক্ষেত্রে নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তান স্বৈরাচার ও স্বাধীন বাংলাদেশে সামাজিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি মুক্তচিন্তার দৈনিককে যে কী পরিমাণ লড়াই করে টিকে থাকতে হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।” ( দৈনিক আজাদী: নামই যার শিরোনাম)
মো. সেকান্দর চৌধুরীর বাংলা ও ইংরেজিতে বহু গবেষণামূলক মননশীল প্রবন্ধ–নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকমানের জার্নাল ও পত্রিকায়। এসব রচনা থেকে নির্বাচিত ২২টি নিয়েই এই গ্রন্থ-‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শেখ হাসিনা।’ ইতোপূর্বে তাঁর আরও দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একটি হলো–বাংলার মুসলিম সমাজ ও রাজনীতি (১৯২৫–১৯৪০) এবং অন্যটি-‘বাংলাদেশ সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি।’ ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শেখ হাসিনা’ গ্রন্থটি এরই ধারবাহিকতা।
নিরঙ্কুশভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক। আর শেখ হাসিনা হলেন এরই ক্রম পরিণতি এবং চূড়ান্ত মীমাংসা। একারণেই লেখকের মূল্যায়ন; “শেখ হাসিনা মানে সুশাসন, উন্নয়ন ও বৈষম্যহীন সামাজিক ন্যায়বিচার। তাই গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ে শেখ হাসিনার ‘রূপকল্প–৪১’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনার এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।’
গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলোর শিরোনামের মধ্যেও এক বিশেষত্ব ও মৌলিকত্ব রয়েছে। যেমন– ‘বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড়’ বা ‘ওই মহামানব আসে’ ইত্যাদি। স্মার্ট, গতিশীল, টানটান–কাব্যময় গদ্যে রচিত এই ঋদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে চন্দ্রবিন্দু। রুচিসিদ্ধ প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। গ্রন্থটির মূল্য:৩০০ টাকা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক