স্বাধীনতার মাসকে বলি অগ্নিঝরা মার্চ। এই মার্চ মাসে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটেছিলো নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে আমরা এক ধরনের নস্টালজিয়ায় ফিরে যাই। কত ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা–তা অনুভব করতে হলে আমাদের একাত্তরের মার্চে ফিরে যেতে হয় বারবার। বাঙালির নানা ইতিহাসের সাক্ষী এই মার্চ মাস। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নানা কারণে মার্চ মাস ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি মাস। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মার্চের প্রথম সপ্তাহের ৭ই মার্চ পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।
রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো– ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যেই স্বাধীনতার প্রকৃত বীজ বপন হয়ে গিয়েছিলো। যে সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এতে তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় মেলে। বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বাধীনতার এই মাস মার্চেই সরাসরি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। তাই রক্তঝরা এই মার্চ মাসের রয়েছে অন্য এক রকমের আবেদন। ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসর্কোস ময়দানে যা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া এই ঐতিহাসিক ভাষণ ছিলো আমাদের জাতীয় জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। লাখো মানুষের দৃপ্ত কন্ঠের উচ্চারণে কেঁপে উঠেছিল দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা উড়ছিলো সারা দেশময়। মার্চের এই দিনটি ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটি দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির কামান–বন্দুক–মেশিনগানের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে বুদ্ধিদীপ্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা জাতির ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দেয়ার একটি মাইলফলক। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে উজ্জ্বল হয়ে মিশে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান। তাঁর বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দুই মিলে রচিত হয়েছিলো আমাদের স্বপ্ন। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনে তাঁর মেধা, এদেশের জনগণের আবেগ, স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে একসূত্রে গ্রথিত করে স্বপ্নের বন্দরে তরী ভিড়াতে পেরেছেন বলেই তিনি আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির আর কোনো নেতৃত্ব স্বাধীনতার মত এমন আরাধ্য ধন বাঙালিকে এনে দিতে পারেননি। মার্চের সাত তারিখের ঐতিহাসিক ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। তার ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্বকে কোনো সীমারেখায় আবদ্ধ করা চলে না। ৭ই মার্চের ভাষণের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক এক প্রেক্ষাপট ও বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর নিপীড়নের ইতিহাস। এই ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস। পৃথিবীতে অন্য কোন ভাষণ এতবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আর শোনা হয়নি। মার্চ এলেই যেন বাঙালিরা আবার সেই দিনে ফিরে যায়। ২৫ মার্চের রাতটিকে বর্ণনা করা হয় ‘কালরাত্রি’ হিসেবে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনি ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ওই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নামকরণ করেছিলো ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ মানবসভ্যতার ইতিহাসে একাত্তরের ২৫ মার্চের রাত হচ্ছে অভিশপ্ত একরাত। এ রাতে শুধু ঢাকায় প্রায় অর্ধলক্ষ লোক প্রাণ হারান। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে স্মরণ করে হত্যাযজ্ঞের দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশে পালিত হয়। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও সেই নৃশংস ঘটনার স্মরণে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ মহান জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এরপর এই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসাবে বাঙালি জাতি স্মরণ করে আসছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার গভীর রাতে বর্তমান বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর হামলা চালায় ও গ্রেপ্তার করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে গ্রেপ্তারের কিছুক্ষণ আগেই ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই জন্যই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে স্বাধীনতা দিবসের যে সূচনা হয় সে সূচনায় শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের এই যুদ্ধের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ ও রক্তের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বহু প্রত্যাশিত বিজয় আসে। বাংলাদেশ অর্জন করে তার বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। তাই প্রতিবছর ২৬ মার্চকে পালন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে। দেশ স্বাধীন হবার পর সরকার কর্তৃক ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক বিশেষ প্রজ্ঞাপনে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার ঘোষণা দেয়া হয়। এই মার্চ মাস আরো একদিকে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ই মার্চ বাঙালির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর একটি নাম নয় নিজেই একা একটি ইতিহাস। তাঁর জীবন ও রাজনীতি স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যেন ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কে জানতো যে মার্চ মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই মাসেই তাঁর মাধ্যমে সৃষ্টি হবে এ দেশের নানা ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ? ১৯৭১ এর ১ মার্চ হতে ৩১ মার্চের নানা ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের ইতিহাসের পাতায় সবসময় উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়ায়। প্রতিটি দিনই যেন এক একটি ইতিহাস। এই একাত্তরের মার্চের প্রতিটি দিন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেই দিনগুলির প্রতিটি দিনই স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে একেকটি মাইলফলক হয়ে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করেছে। পাকিস্তানিদের সাথে নানা ঘটনা পরম্পরায় সৃষ্টি হয়েছে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫শে মার্চের কালরাত্রির বিভৎস এক গণহত্যার রাত, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের মত উজ্জ্বলময় দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মমাস মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বপ্নের স্বাধীনতা পেতে উজ্জ্বীবিত করতে পেরেছিলেন তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে। তাই মার্চ মাস এবং বঙ্গবন্ধু যেন একাকার হয়ে মিশে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক, কলেজ শিক্ষক।