বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১৬ জুলাই, ২০২২ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সদাদীপ্ত লালিত স্বপ্ন ছিল স্বজাত্যবোধনির্ভর একটি গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক-দারিদ্র ও শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণ। মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধে ঋদ্ধ ঈমান-দেশপ্রেমের অবিচল শক্তিমানতায় ধারণ করেছিলেন বাঙালির রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আদর্শ। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম-মহান মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় নানামুখী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের শিকারে জীবনের দীর্ঘ সময় কারাভোগ-প্রায় সপরিবারে জীবন বিসর্জনে কখনো আপোষ-নতিস্বীকার না করেই বিশ্বে বিস্ময়কর অবিসংবাদিত নেতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিশোর থেকে শুরু করে ছাত্রজীবন ও পরবর্তী রাজনৈতিক সময়কালে ব্রিটিশ-ভারত-পাকিস্তান নামক ভঙ্গুর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-অঞ্চল-অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতির বিরোধ-বিচ্ছেদ-সংঘাত-দাঙ্গা ইত্যাদি অবলোকনে যারপরনাই ব্যথাহত জীবন পরিচালনা করেছেন। এসব যন্ত্রণাদগ্ধ অভিজ্ঞতার অলোকেই মুক্ত মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা এবং সৌহার্দ-সম্প্রীতি-মনুষ্যত্বের পরিচায়ক এক অতুলনীয় জাতিরাষ্ট্রের আবির্ভাবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অভিনব আলোকবর্তিকা।
জনশ্রুতিমতে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে যথার্থ অর্থবহ করার উদ্দেশ্যে নিগূঢ় নিষ্ঠার সাথে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাক্কালেই যেসব অপশক্তি সক্রিয় ছিল তাদের বশংবদ-অন্ধকারের শক্তিগুলোর হীন তৎপরতা প্রকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে দেশকে অস্থিতিশীল করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সংস্থার ভূমিকা দেশবাসী নতুন করে উপলব্ধি করছে।
বিভিন্ন সামাজিক-গণমাধ্যম তথ্যানুসারে মধ্যযুগে ভারতবর্ষে হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানদের উপর প্রায়শই সহিংস আক্রমণ সংঘটিত হতো যেগুলোকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ভারতে সবচেয়ে বেশি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে। তৎকালীন সংঘটিত বড় সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৪৬ সালে পূর্ব কলকাতার নোয়াখালী দাঙ্গা পরবর্তী ১৯৪৬ সালে বিহার ও গরমুখেশ্বরে গ্রেট কলকাতা হত্যাকান্ড, ১৯৪৭ হায়দরাবাদ ও জম্মুতে মুসলমান হত্যাযজ্ঞ, ১৯৫০ সালে বরিশাল, ১৯৬৯ এর আহমেদাবাদ, ১৯৮০ সালে মুরাদাবাদ, ১৯৮৩ সালের নেলি, ১৯৮৪ সালে ভিওলান্দি, ১৯৮৫ ও ২০০২’র গুজরাট, ১৯৮২ ও ১৯৮৭ সালে মিরাট, ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর ও মুম্বাই, ১৯৯২ সালে মুম্বাই ও অযোধ্যা, ২০১৩ সালে মুজাফফরনগর এবং ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা ইত্যাদি। ১৯৫০ সাল থেকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৮২ এবং ১৯৬৮ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে মোট ৬৯৩৩ জন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়। ২০১০ -২০১৭ পর্যন্ত ভারতে গরু জাগ্রত সহিংসতার শিকার হওয়াদের ৮৪ শতাংশই ছিল মুসলিম।
কলকাতা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় প্রায় শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল এবং আহত হয়েছিল ৪৩৮ জন। গ্রেফতার করা হয়েছিল ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে। উক্ত ঘটনায় ৭০ হাজারের বেশি মুসলমান তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। আসাম রাজ্যের নেলি গণহত্যায় বাঙালি বংশোদ্ভূত ১ হাজার ৮০০ জন মুসলমানকে লালুং উপজাতি কর্তৃক হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের গুজরাট দাঙ্গায় আনুমানিক ৩০ জন প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৭০ এর ভাওয়ান্দি দাঙ্গায় মুসলিম মালিকানাধীন সম্পদের ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছিল। মুরাদাবাদ দাঙ্গায় আনুমানিক ২ হাজার ৫০০ এবং ভাগলপুরে সহস্রাধিক লোক মারা যায়। ১৯৯২ সালের মোম্বাই দাঙ্গায় মারা যায় ৯০০ জন, আহত ২০৩৬ এবং বাস্তুচ্যুত হয় হাজার হাজার মানুষ। ২০০২ সালে ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ খ্যাত গুজরাট সহিংসতা যেটি মুসলমান কর্তৃক গোদরা ট্রেন পোড়ানোর অভিযোগে সংঘটিত হয়েছিল। ঐ সময় অল্প বয়সী মেয়েদের যৌন নির্যাতন-কুপিয়ে হত্যা ও পোড়ানো হয়েছিল। উল্লেখ্য সহিংসতায় ৭৯০ জন মুসলিম এবং ২৫৪ জন হিন্দু মারা যায়। ২০১৩ সালে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মুজাফফরনগর জেলায় হিন্দু-মুসলমান দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে ৪২ মুসলমান ও ২০ হিন্দুসহ কমপক্ষে ৬২ জন মারা যায়। আহত হয়েছে প্রায় ২০০ এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছিল ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০২০ সালের দিল্লির দাঙ্গায় ৫৩ জন নিহত ও ২০০ জনের অধিক আহত হয়েছিল। ১৯৫০ এর দশক থেকে ভারতে মুসলিম বিরোধী সহিংসতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো হয়েছিল। ১৯৯২ সালের মুম্বাই সহিংসতার পর ব্রিটেন, দুবাই ও থাইল্যান্ডে হিন্দু মন্দিরে হামলা হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী এই সহিংসতা প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল। ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার রাম মন্দির বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী কর্মসূচি শুরু হয়। ১৯৯০ সালের ২৯ অক্টোবর রাজনৈতিক মদদপুষ্ট দেশের একটি পত্রিকার শিরোনাম ‘বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে’ মর্মে সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী বাবরী মসজিদ ধ্বংসের গুজব রটানো হয়েছিল। উক্ত গুজবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশী মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত টানা চার দিন হিন্দুদের উপর বর্বর হামলা চালানো হয়। এছাড়া একই ঘটনার সূত্রপাতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সমগ্র দেশজুড়ে বিরতিহীনভাবে হিন্দুদের উপর চলতে থাকে আত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণের মত জঘন্য নিষ্ঠুরতা। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের কমপক্ষে ১২ টি শহরের হিন্দু সম্প্রদায় তখন হামলার শিকার হয়েছিল। সে সময় ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসসহ দেশের বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরের এক হিন্দু জেলে দ্বারা ফেসবুকে ইসলাম বিরোধী পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১৯ টি মন্দির ও প্রায় ৩০০টি বাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং আহত হয় ১০০ জনেরও বেশি হিন্দু। ১৭ মার্চ ২০২১ এক হিন্দু ছেলে কর্তৃক দেশের কথিত একটি ইসলামী দলের বহিষ্কৃত নেতাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তির অভিযোগে সুনামগঙ্গের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর নোয়াগাঁও গ্রামে মাইকে ঘোষণা দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়। ২০২১ সালে কুমিল্লায় সংঘটিত সর্বজনিন দুর্গোৎসব উদযাপনে পূজামন্ডপে পবিত্র কুরআন শরীফ রাখার বিষয়টি সত্য-মিথ্যা যাচাই ব্যতিরেকে পবিত্র ইসলাম বিরোধী দাঙ্গা হাঙ্গামার অবতারণা সত্যিই দু:খজনক-অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত। ধর্মপ্রাণ কোন মুসলমানের কিছুতেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন ছাড়া বিশ্বাস করা সমীচীন হবে না; হিন্দু কেন যেকোন ধর্মাবলম্বীর দেবদেবী-পূজাঅর্চণা-পূজামন্ডপে পবিত্র কুরআনের অবমাননাকর ন্যূনতম কোন কুৎসিত কর্মযজ্ঞ সম্পাদন হতে পারে। অন্যান্য পবিত্র ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থকে অবজ্ঞা-কটূক্তি করে কোন ধার্মিক মানুষ কর্তৃক ধর্মীয় প্রার্থনা-উপসনাকে কলুষিত করার নজির বিশ্বে বিরল।
শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে প্রায়ই মুসলিম বিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশ্লেষকদের মতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি অংশের প্রচারণাই এর জন্য দায়ী। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে চার মুসলমানের হামলায় এক বৌদ্ধ নাগরিকের আহত হওয়ার অভিযোগে মুসলমানদের মসজিদ, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামালা চালানো হয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমান রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে পালিয়ে যাওয়ার পিছনেও রয়েছে মৌলবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রত্যক্ষ মদদ। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিমপ্রধান রাজ্যগুলোতে ২০০১ সাল থেকে মাঝেমধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। দৈনিক ‘ব্যাংকক পোস্ট’র হিসেবে ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উল্লেখ্য অঞ্চলে সহিংসতায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অতিসম্প্রতি ভারতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবমাননা এবং উস্কানিমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া প্রচন্ড বিক্ষোভ নতুন করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রূপ ধারণ করে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির অমূলক-অযৌক্তিক-নিষ্ঠুর দাঙ্গা-হাঙ্গামার নির্দয় অভিজ্ঞতার অপরিমেয় কাতরতায় ব্যথিত ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এহেন অযাচিত-অবাঞ্চিত-অনভিপ্রেত বিচ্যুতি থেকে পরিত্রাণ লাভে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক মানসে কালপরিক্রমায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিগ্রহে তিনি পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উৎসসূত্রে প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ ছিল বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ। সকল ধরনের ধর্মান্ধতা পরিহারে ধার্মিকতার মানবিক-নান্দনিক-পরিশীলিত মূল্যবোধকে ধারণ করে স্বাধীনতা অর্জনের মূলমন্ত্র হিসেবে কার্যকর ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের পবিত্র সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আদর্শ প্রতিস্থাপনে বঙ্গবন্ধু শুধু বিশ্ব পরিমণ্ডলে মানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন নি; রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করে তিনি অসাম্প্রদায়িক অবিনাশী চেতনার প্রচেতা হিসেবে জাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদাসীন করেছেন।
১৯৭২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতির আদর্শের মৌলিক চারটি স্তম্ভ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বিশদ ব্যখ্যা দিয়েছেন। চতুর্থ স্তম্ভ – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু মনুষ্যত্বের সাবলীল ও স্বাভাবিক প্রকাশে বাঙালি স্বজাত্যবোধের মূল্যায়নে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে অসাধারণ বিশ্লেষণে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকবৃন্দের গ্রহণযোগ্য ধর্ম পালনের সৌকর্যকে উদঘাটিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ-সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নিচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামিন। রাব্বুল মুসলিমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক. মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সব মানুষ তার কাছে সমান। সে জন্যই একমুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আরেক মুখে সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পশ্চিম। যারা এ বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনো দিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন না করতে পারে।’ প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখিত ভাষণের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনা-দর্শন-দেশপ্রেম-ধার্মিকতায় অচ্ছেদ্য মূল্যবোধের নবতর আবিষ্কার-পরিচর্যা-অনুশীলনের এখনই যোগতম পর্যায় হিসেবে জাতিকে ধারণ করতেই হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধবরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকায় হঠাৎ মন্ত্রমুগ্ধ গোলাপি আকাশ