বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র চিন্তা

কানাই দাশ | বুধবার , ২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়ন, মানুষের শ্রমলব্ধ সম্পদ গোষ্ঠীপতিদের আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় এক সময় রাষ্ট্‌্েরর উৎপত্তি হয়। এক্ষেত্রে এথেন্সের দাসশ্রম ভিত্তিক গড়ে উঠা নগর রাষ্ট্র প্লেটোর আলোচনায় এসেছে। এর পূর্বাপর সময়ে ভারতে, চীনে মেসোপটমিয়া বা মিশরে রাষ্ট্র ও সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও সুসমন্বিত কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলোর মত। সে সব সভ্যতার কেন্দ্রে ছিল প্রাকৃতিক ধর্ম ও দর্শন ভিত্তিক এক ধরনের থিওলজিক্যাল শাসন ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে চীনের কনফুসিয়াসের ও ভারতে কৌটিল্যের রাষ্ট্র চিন্তার উল্লেখ করা যায়। কিন্তু প্লেটো ও এরিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও একাডেমিক জগতে এখনো অবশ্য আলোচিত একটি বিষয়।

প্লেটোর মতানুযায়ী কোনো বাস্তব রাষ্ট্রই যথার্থ অর্থে পরিপূর্ণ রাষ্ট্র নয় আর পরিপূর্ণ রাষ্ট্রই হল আদর্শ রাষ্ট্র। অথচ তিনি দাস শ্রম ভিত্তিক গ্রীক নগর রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণ আদর্শ রাষ্ট্র কি করে বলছেন তা বুঝতে হবে তাঁকে তাঁর কালের প্রেক্ষিতে বিচারের মাধ্যমে। এরিস্টটলের কাছে আবার প্রত্যেকটি বাস্তব রাষ্ট্রই হল পরিপূর্ণ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নিয়ে প্লেটোর বিমূর্ত ভাববাদী দার্শনিক আলোচনা থেকে তাঁর শিষ্য এরিস্টটল রাষ্ট্র চিন্তাকে বাস্তবের সম্ভাবনাময় কাঠামোয় দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। কাজেই পর্যবেক্ষণলব্ধ তুলনামূলক ও ইতিহাস ভিত্তিক রাষ্ট্র চিন্তার প্রাচীন অগ্রপথিক হলেন এরিস্টটল। তিনি বলেছেন শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজই রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্‌্েরর বাইরে মানুষের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান মতে সমাজ এবং রাষ্ট্র এক নয়। সমাজ ও জীবনের বিকাশের এক পর্যায়ে রাষ্ট্র সংগঠনের উৎপত্তি। রাষ্ট্র মানুষের স্বভাবের প্রকাশ বটে কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে মানুষের অস্তিত্ব অকল্পনীয় নয়। রাষ্ট্র বলতে প্রধানত দণ্ড প্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনকে বোঝায়।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার পটভূমি এ প্রেক্ষিতে আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা এক সময় ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত সদ্য স্বাধীন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতাদের রাষ্ট্রচিন্তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল যদিও তাঁরা অনেকেই প্রলেতারীয় ডিক্টেটরশীপের রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা প্রচলিত কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থা সমর্থন করেননি বা মার্কসবাদী রাষ্ট্র চিন্তায় ভাবিত ছিলেন না। তাঁরা রাষ্ট্র নিয়ে এরিস্টটলীয় চিন্তায় প্রভাবিত ছিলেন এ মর্মে যে, প্রত্যেকটি রাষ্ট্র কোনো উত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা। কিন্তু তাঁদের বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা ও অতীতের ঔপনিবেশিক নিপীড়ন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা বিরোধিতা ও তাঁদের সংগ্রামে তৎকালীন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অকুণ্ঠ ও কার্যকর সমর্থন তাঁদের পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান নিতে উৎসাহিত করে। ফলে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে এসব সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিশেষতঃ স্বনির্ভর জাতীয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব উন্নয়নশীল জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির স্বাধীন ভূমিকা সুনজরে দেখেনি। ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে এসব দেশে রেজিম চেঞ্জের ভূমিকার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে। নানা অনৈতিক উপায়ে পুরো ল্যাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষপুটে নিয়ে নেয় যা ক্ষুব্ধ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের দেশপ্রেমিক রাষ্ট্র নেতাদের। ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুকর্নকে, চিলির রাষ্ট্রপতি আলেন্দকে সামরিক বাহিনি দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার ঘটনায় প্রকাশ্যে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরি প্রেক্ষিতে আলেন্দের মৃত্যুর পর ১৯৭৩ সালে দৃঢ়চিত্ত বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ‘আলেন্দের মত অবস্থা হলেও মাথা নত করব না।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন সর্বজনবিদিত। ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস হলো আজকেও বাংলাদেশে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন কৌশলে রেজিম চেঞ্জের প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মতই ক্রমবিবর্তনের পথে এগিয়েছে। তাঁর সহজাত শ্রেয়োবোধ, কথা ও কাজের আন্তরিক মিল, অতুলনীয় সাহস, ঔদার্য, মানুষের জন্য মমত্ববোধ তাঁকে রাজনীতির ডানপন্থা থেকে অনিবার্যভাবে ক্রমে ধাপে ধাপে মধ্য বাম পন্থায় নিয়ে গেছে। মতাদর্শিক অবস্থান নয় প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা তাঁকে র‌্যাডিকেল করে তুলে। তিনি ক্রমে তাঁর সহযোদ্ধা ঘনিষ্ঠদের এমনকি তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বুর্জোয়া ডেমোক্র্যাসির দক্ষিণপন্থী ধারা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন এবং প্রথমাবধি আওয়ামী লীগকে একটি সেকুলার লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক দলে পরিণত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলার দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন পাকিস্তান নামক এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে কেননা তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলিম জমিদার ছাড়া অধিকাংশ জমিদার ছিলেন সম্প্রদায়গত ভাবে হিন্দু। তিনি আন্তরিকভাবে মনে করেছিলেন পাকিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্রে হিন্দু জমিদারদের শোষণ থেকে দরিদ্র মুসলিম কৃষক জনতা অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পাবে। তাঁর প্রাথমিক রাস্ট্র চিন্তা তাই অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিপ্রতীপ ভাবাদর্শ থেকে উদ্ভূত এবং বাহ্যত মনে হলেও নিছক তা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চিন্তা ছিল না। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলছেন ‘আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যেকোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে তারা কোনদিন কোন রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না’ (পৃষ্ঠা২৫৮)। এ ধরনের চিন্তা বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কতটুকু দেখা যায়? পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজমকে তিনি দেখেছিলেন ভবিষ্যত গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের একজন সেকুলার ডেমোক্র্যাট নেতা হিসাবে। সে সময় তাঁর রাষ্ট্র চিন্তায় ঔপনিবেশিক শাসন ও সামন্তবাদী শোষণ মুক্ত বুর্জোয়া ডেমোক্র্যাসির প্রভাব ছিল স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু ৪৭ পরবর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ১৯৪৮ সালেই তিনি সিদ্ধান্তে চলে আসেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে পূর্ব বাংলার শুধু দরিদ্র মুসলিম কৃষক নয় প্রকৃত অর্থে আপামর বাঙালির অধিকার অর্জন সম্ভব নয়। তাঁর রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক চিন্তা সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে প্রসারিত ও পরিশীলিত হতে শুরু করে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর’ এক জায়গায় তিনি বলছেন ‘আমি ফেরেশতা নই আমি মানুষ’। এই আন্তরিক আত্মোপলব্ধি তাঁকে ক্রমে শুদ্ধ রাজনীতির পথে নিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ দেশের রাজনীতিতে যেমন যুগান্তকারী বাঁক পরিবর্তন ঘটিয়েছে তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার আমূল পরিবর্তন এনেছে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরপরই ১৯৫৫ সালে মূলত তাঁরই উদ্যোগে প্রভাবশালী নেতাদের বিরোধিতার মুখে প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের মাথায় নিজ দলের নাম পরিবর্তন করে মুসলিম আওয়ামী লীগ থেকে আওয়ামী লীগ করেন। স্মর্তব্য তখনো কিন্তু এদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ভাবাদর্শ সমাজে যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু তিনি আপস করেননি।

সে বছর তাঁর নয়াচীন সফর ও সে দেশের বৈপ্লবিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে রাষ্ট্র ভাবনার দিক থেকে তিনি এক উন্নত স্তরে উন্নীত হন। এক সময়ের দরিদ্র চীনা জনগণের জীবনের গুণগত পরিবর্তন দেখে, আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অশিক্ষিত নিরক্ষর চীনের মানুষের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার দেখে, শিল্পে কৃষিতে বিপ্লবোত্তর চীনের অভাবনীয় অগ্রগতি দেখে তিনি অভিভূত হন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি সেই ১৯৫৫ সনে স্পষ্ট বলছেন ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর’ (পৃষ্ঠা২৩৪)

১৯৭২ সালেই তিনি স্বাধীন দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন যা তাঁর পরিবর্তিত রাষ্ট্র চিন্তার মূর্ত দলিল। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেছে নেন। একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পরে ছাত্র, যুব সমাজ তথা মানুষের জীবন বোধে, আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে বলতে গেলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে একটি নিখাদ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চিন্তা থেকে তিনি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের নিজ দলের তরুণদের দাবী এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ন্যাপসিপিবি’র পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতীয় সরকার গঠনের দাবী উপেক্ষা করেছেন। সমাজতন্ত্রকে সাংবিধানিক লক্ষ্য ঘোষণা করে ও গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার লক্ষ্য ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সংবিধান প্রণীত হওয়ার আগেই ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকীর প্রাক্কালে প্রদত্ত ভাষণে তিনি অপুঁজিবাদী বিকাশের পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের দিকে দেশকে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে দেশিবিদেশি ব্যাংকবীমা, কলকারখানা জাতীয়করণ করার কথা বলেন। টিসিবি গঠন করে আমদানী রফতানী বাণিজ্যের সিংহভাগ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সিলিং নির্ধারণ করে দেন। এরি সাথে প্রগতিশীল রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে শিক্ষার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য, সর্বজনীন সেকুলার ও একমুখী শিক্ষায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে সমাজ প্রগতির কারিগর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য গঠন করেন ড. কুদরতখুদা শিক্ষা কমিশন। এসব প্রগতিশীল আর্থিক ও সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করার সাথে সাথেই শুরু হয় দেশী বিদেশী চক্রান্ত। সেই চক্রান্তে দেশের অভ্যন্তরে তাঁর নিজ দলের দক্ষিণপন্থি অংশ, মাওবাদী হঠকারী বাম, প্রশাসনের একটি অংশ, অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তা পর্যন্ত যুক্ত হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে পাকমার্কিনসৌদি অক্ষশক্তি এতে ক্রমাগত ইন্ধন দিতে থাকে। দলীয় কর্মীদের একাংশের দুর্নীতি, বেপরোয়া মনোভাব মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। এমতাবস্থায়, দলের ভেতরে বাইরে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিবর্তনকামী অংশ নানা চক্রান্তের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ’৭৪ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারসাজিতে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু তাঁকে রাজনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়। তিনি দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং তাঁর দীর্ঘ লালিত রাষ্ট্রচিন্তা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তাঁকে সাময়িক ভাবে কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার বাদ দিতে বাধ্য করে। ১৯৫৫ সালের পর দ্বিতীয়বার তিনি তাঁর প্রিয় দলের নাম পরিবর্তন করে সব মত ও পথের মানুষকে নিয়ে গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল। কৃষিতে বাধ্যতামূলক সমবায় ভিত্তিক ভূমি সংস্কার সহ কিছু বৈপ্লবিক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা সীমিত করার পদক্ষেপ নেন। পত্র পত্রিকা তথা প্রিন্ট মিডিয়াকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। কালো টাকা উদ্ধার করে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং দ্রুতই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে ’৭৫ এর প্রথমার্ধেই। তিনি তাঁর সর্বশেষ রাষ্ট্র চিন্তা থেকে গৃহীত এসব ব্যবস্থাকে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেন। মানুষের মুক্তি তথা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে তাঁর সর্বশেষ রাষ্ট্রচিন্তা এভাবে প্রতিভাত হয়।

পাক মার্কিন শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অনুচররা, সমাজ প্রগতির শত্রুরা ’৭১ এর পরাজিত শক্তি সম্মিলিত চক্রান্ত সুযোগ বুঝে তাঁকে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করে প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও কল্যাণকামী বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন ও একটি অনন্য সাধারণ কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র চিন্তার অবসান ঘটে। আজকের সংকটাপন্ন লুটেরা পুঁজি প্রভাবিত জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পূর্তির প্রাক্কালে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃত অনুসারীরা কতটা কী করছে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ তাঁর এই দুই গ্রন্থের মূল স্পিরিট তাঁর দল আন্তরিকভাবে অনুসরণ করলে দেশের পরিস্থিতির আজকের এই অধোগতি আমাদের দেখতে হতো না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধপাইওনিয়ার ফুটবল লিগে এন্ট্রির সময় বৃদ্ধি