বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা

রাশেদ রউফ | শনিবার , ১৩ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক ব্যক্তিত্ব যিনি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও অতুলনীয়। ত্যাগ ও দেশপ্রেমের মহিমায় ভাস্বর তাঁর মহাজীবন। তাঁর উদারতা, দয়া, মহানুভবতা তাঁকে করে তুলেছে ইতিহাসের বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বে।
ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে বাস করতো দয়া ও মানবিকতা। ভয়-ভীতি ছিলো না তার চরিত্রে। ছিল সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা ও বলিষ্ঠতার নিরেট সমন্বয়। মাথা তুলে দাঁড়াতেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।কথা বলতেন বুক উঁচিয়ে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট। এসব চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি হয়ে ওঠেন সবার ‘মুজিব ভাই’।
স্কুলে পড়া অবস্থায় তার মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। দুস্থ, গরীব, আর্তদের সেবা করার মধ্য দিয়ে মহানুভবতা আর মানবতার আদর্শে দীক্ষিত হন। সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দরদ, বিপদে-আপদে অকুণ্ঠভাবে সাহায্য-সহযোগিতা তার জীবনের অনুপম বৈশিষ্ট্য। ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, হাস্যোজ্জ্বল মুখের মিষ্টি কথা, অন্তরঙ্গ ব্যবহার ও খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের কারণে অল্পদিনেই স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র সবারই প্রিয় হয়ে উঠলেন মুজিব। স্কুলের যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠানে তাঁর থাকত সক্রিয় ভূমিকা, এমনকি অনেক সামাজিক কাজেও মুজিব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। যেকোনো ধরনের কাজেই মুজিব এগিয়ে গেলে অন্য ছাত্ররাও তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যেত সেই কাজে। শৈশবকাল থেকেই মুজিবের খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফুটবল খেলায় তিনি বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ভলিবল খেলায় তাঁর বেশ আগ্রহ দেখা যেত। গুরুসদয় দত্ত প্রবর্তিত ‘ব্রতচারী নৃত্যে’র প্রতি তিনি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। পূর্ণ বয়স হলে তাঁর মধ্যে যে মহানুভবতা, ঔদার্য, সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিক দরদ, সৎ সাহস, মানুষের বিপদে-আপদে অকুণ্ঠচিত্তে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া, সমাজের যেকোনো স্তর ও পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা প্রভৃতি গুণাবলি দেখা যায়, শৈশবেই তার প্রকাশ ঘটে। ‘উঠন্ত মূলো পত্তনেই চেনা যায়’-এ প্রবাদের সত্যতা প্রমাণিত হয় মুজিবের জীবনে। এ বিষয়ের সঙ্গে ইংরেজি প্রবাদবাক্য ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ খুবই প্রাসঙ্গিক।
প্রতিটি বাঙালির একান্ত বিশ্বাস যে, বঙ্গবন্ধুর নিজের কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তিনি মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চান না। না প্রধানমন্ত্রীত্ব না প্রভুত্ব। তার কাছে, অর্থ, সম্পদ, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন ও ঐশ্বর্য সবই ছিলো তুচ্ছ। মানুষকে ভালবাসতেন বলেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু থেকে গেছেন মানুষের কাতারেই। বিদেশি সাংবাদিক বরার্ট ফ্রস্ট একবার বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার সবচেয়ে ভালো গুণ কী? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাঙালিকে ভালোবাসি। রবার্ট ফ্রস্ট তাকে পুনরায় প্রশ্ন করেন, আপনার খারাপ গুণ কী? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালিকে আমি বেশি ভালোবাসি। তিনি যে সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন আপন করে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনের ভাষ্য, তিনি যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, তখনও ৩২ নম্বরের বাড়িটি দেখার অনেকের মধ্যেই কৌতুহল ছিলো। ৩২ নম্বরের বাড়িটির দরজা সাধারণ মানুষের জন্য ছিলো সবসময় খোলা। কেউ সাহস করে বাড়িতে না ঢুকে উঁকিঝুঁকি মারলেই বঙ্গবন্ধু ডেকে নিতেন তাকে। পাশে বসিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইতেন তাদের অভাব অভিযোগের কথা। আগন্তুককে কিছু না কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করতেন, আপ্যায়ন করতেন নিজ হাতে। বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে মানবিকতার সকল গুণাবলীই নিহিত ছিলো। তিনি মনে করতেন নেতার বাড়িতে যাবার অধিকার দেশের জনসাধারণের আছে। এটা তাদের মানবাধিকার। তারা ভোট দিয়ে নেতা বানায়, প্রধানমন্ত্রী বানায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জািতর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভেতর সবসময় একটা দানশীল মনোভাব ছিল, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল। যে কারণে ছাত্রদের নিজের বই, কাপড়, ছাতা বিলিয়ে দিতেন। পরিবারের সহযোগিতায় বিরাট হৃদয়ের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এদেশে প্রায়ই দুর্ভিক্ষ লেগে থাকতো, নিজের গোলা খুলে দিয়ে ধান বিলিয়ে দিতেন তিনি। জাতির পিতা মানব দরদি ছিলেন। অন্য ছাত্রদের নিজের বই, কাপড়, ছাতা বিলিয়ে দিতেন। এই যে বই দিয়ে দিলেন, কাপড় দিয়ে দিলেন এ জন্য আমার দাদা-দাদি কখনও আমার বাবাকে কিছু বলতেন না, বরং তাকে সবসময় সহযোগিতা করতেন। ভাবতেন তিনি দেশের জন্য কাজ করতেন। এ জন্য তাকে সাহায্য করতেন। আমার মাও সাহায্য করতেন। কখনও বাবার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করতেন না। এ কারণেই তিনি এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলেন। সবসময় তাঁর ভেতরে একটা দানশীল মনোভাব ছিল, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসার টানেই তিনি আমাদের এই স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন। (২০১৯ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ)।
আসলে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল মানবতাবাদ। সব ধর্ম আর সব বর্ণের জনগণের প্রতি ভালোবাসার মধ্যেই শেখ মুজিবের অসামপ্রদায়িকতার আদর্শ নিহিত ছিলো। পারিবারিক প্রণোদনা তাকে শিখিয়েছে বাংলার কৃষক তার ভাই, নিরন্ন দুখি মানুষ তার ভাই।
গণভবনের সাবেক স্টোরকিপার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, একদিন বিকালে গণভবনের কর্মচারী রেজাউল নামে একজন বঙ্গবন্ধুকে চা দিচ্ছিলেন। এ সময় রেজাউলকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর চেহারা মলিন কেন? উত্তরে রেজাউল বলেন, স্যার বেতন হয় না তিন মাস। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোলার আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠান এবং জানতে চান ওদের বেতন হয় না কেন? খায়ের বলেন, জটিলতা আছে। বঙ্গবন্ধু তত্‌ক্ষণাৎ বলেন, আমি কিচ্ছু বুঝি না, একদিনের মধ্যে বেতন হওয়া চাই। একদিন বাদেই বেতন হয়েছে। ঘটনাগুলো বলার কারণ হলো বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা ছিলেন যার দৃষ্টিভঙ্গি ধনী-গরিব, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তাঁর চোখে সমান ছিল। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা ও ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই ছিল ম্রিয়মাণ।
আফরোজা পারভীন তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা ও দানশীলতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, জীবনের অধিকাংশ সময় জেলে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ফজিলাতুননেসা মুজিবকে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকায় অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন বঙ্গমাতা। ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন খুবই কষ্ট করে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিকাংশ সময় যদি জেলে না কাটতো তাহলে এদেশের প্রতিটি মানুষের সুখে দুঃখে দাঁড়াতে পারতেন তাদের পাশে। কিন্তু তিনি তার জীবনের অমূল্য সময় যৌবনটাই কাটিয়েছেন জেলে। তারপরও যখনই পেরেছেন দুহাত উজাড় করে দিয়েছেন। তার কাছে এসে খালি হাতে বা শুকনো মুখে কেউ কখনই ফিরে যায়নি।
বঙ্গবন্ধু এতটাই ক্ষমাশীল আর দয়াশীল ছিলেন যে, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেবার কথা বলেছেন। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে দেবার কথাও বলেছেন। মাহবুবুল আলম তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর চরিত্র-কৃতিত্ব ও মানবিক গুণাবলী’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহৎ ও ক্ষমাশীল হৃদয়ের অধিকারী। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিরোধী দল ও সংগঠনের লোকজন বিশেষ করে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস যারা সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে বাঙালি ও স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তাদের অনেককেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সাথে জড়িত ছিল তাদের ক্ষমা করেননি। সেই ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আজও মহৎ প্রাণের বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা শুনতে হয়।
মোনায়েম সরকারও বলেছেন, শেখ মুজিবের চরিত্রে অনেক উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ দেখা যায়। তবে তার ক্ষমা এবং ঔদার্য তুলনাহীন। তার ক্ষমার কাছে, ঔদার্যের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। একটি মানুষ কি করে এতটা ক্ষমাশীল আর উদার হতে পারেন যারা বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেন নি তাদের এগুলো বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। পৃথিবীর অনেক নেতা আছেন ইতিহাসে যাদের স্থান হয়েছে লৌহ মানব বা কঠিন শাসক হিসেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য একেবারেই ভিন্ন। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা হয়েও ক্ষমা, দয়া, ঔদার্যের যে মহান কীর্তি গড়ে রেখে গেছেন বাংলার ইতিহাস তথা মহাকালের ইতিহাসে তার এই অসামান্য কীর্তিগাথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু নেতা হিসেবে যত বড় ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তত বড় ছিলেন না। এ কথাটিকে আমি সম্পূর্ণভাবেই প্রত্যাখ্যান করি। নেতা বঙ্গবন্ধু যতটা মহান ছিলেন, রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও পরিপক্ব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর মনের উদারতা তাঁর চরিত্রকে করেছে আরো মহিমান্বিত। দেশবাসীও তাকে ভালোবাসতো প্রাণ দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বেও এমনই একটি জাদুকরি শক্তি ছিল যে, দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১১৬ স্থানে সাঁটানো যাবে পোস্টার
পরবর্তী নিবন্ধসংসার চালাতে হিমশিম