বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী চেতনার উৎস

মুহাম্মদ শামসুল হক | মঙ্গলবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ছাত্রাবস্থা থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন কড়া মুসলিম লীগ সমর্থক এবং পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ তরুণ কর্মী। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং এজন্য প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি তথা বিপ্লবী তৎপরতা চালানোর মতো চিন্তা-চেতনা তাঁর মনোজগতে ঠাঁই পেল কোন উৎস থেকে? এ প্রশ্নের বোধগম্য জবাব পাওয়া যেতে পারে লেখক হাবিব আহমদ দত্ত চৌধুরীর ‘গুরু সদয়ে উদ্ভাসিত মুজিব’ নিবন্ধে। নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো: ‘গুরুসদয়ে উদ্ভাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কথাটা হাল-আমলের রাজনীতিবিদ বা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই আনকোরা ধরনের তাতে সন্দেহ নেই। অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবনেতিহাসের এ অধ্যায়টি ইতিহাসের মানদণ্ডে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
বাংলার নৃত্য, বাংলার সাহিত্য, বাংলার লোকসংগীত, লোকশিল্প, লোককথা, ছড়া, বাঙালির জাতীয় খেলা, বাংলার মেয়েদের আলপনা প্রভৃতি গণশিল্প-সংস্কৃতি বাঙালির জীবনে পুনঃপ্রবর্তন করে জাতীয় জাগরণ ঘটানোই হচ্ছে ব্রতচারী আন্দোলনের মূল কাজ এবং অতঃপর জাতীয় মুক্তি বা স্বরাজ লাভ। এই দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলার ব্রতচারীদের জন্য গুরুসদয় দত্ত দুটি স্লোগানও সৃষ্টি করলেন। প্রথমটি হলো ‘আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমি বাংলার সেবা করবো’ এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘জয় সোনার বাংলা’। অপরদিকে তিনি স্বজাতিকে শাশ্বত বাঙালি হওয়ার আহ্বান জানালেন তাঁর অবিস্মরণীয় ‘বাঙালি হ’ শীর্ষক গানে।
ব্রতচারী আন্দোলনে শামিল হলেন বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম ও মতের জনগণ। বিশেষ করে বাঙলার হিন্দু-মুসলমানের মিলনমেলায় পরিণত হলো এই আন্দোলন। গুরুজির ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ফলে এই আন্দোলন সর্বজনীন আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করলো। প্রথমদিকে ব্রতচারী আন্দোলন ইংরেজদের বিরোধিতা এবং ছোট মাথার কিছু অবাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তির সমালোচনার মুখে পড়লো। গুরুজি অতীব সুবুদ্ধির সঙ্গে ইংরেজ গভর্নর Sir John Anderson-কে এ আন্দোলনের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে বশীভূত করলেন। এদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, নেতাজির অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, দুর্ধর্ষ রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ মহামানবগণ গুরুজির ব্রতচারী আন্দোলনকে স্বাগত জানালেন এবং এর প্রচার ও প্রসারে সর্বাত্মক সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও এই আন্দোলনের একান্ত সমর্থক ছিলেন। কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় কারান্তরালে থাকায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় এ আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারেননি।
শেখ মুজিব ১৯৩১ সালে ভর্তি হলেন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে। এই সময়কালে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতির মাধ্যমেই এর শুরু, এটা পূর্বেই বলা হয়েছে। এ সময়কালে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত বিপ্লবী নায়ক মাস্টারদার নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী রক্তাক্ত বিদ্রোহ ঘটে এবং সমগ্র উপমহাদেশে শুরু হয় ব্যাপক রাজনেতিক ডামাডোল। মাস্টারদার বিপ্লবী অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিলো স্বৈরাচারী ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার। শেখ মুজিব বাল্য বয়স থেকেই ছিলেন অত্যন্ত স্বদেশ-সচেতন এবং দেশের হালহকিকত অনুধাবনের ক্ষমতা তাঁর আর দশজন সহপাঠীর চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রতচারী আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং তা সমগ্র বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে Scouting-এর পাশাপাশি ‘ব্রতচারী শিক্ষণ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলেও এই ব্রতচারী-চর্চা চালু হয়ে যায়। কিশোর বঙ্গবন্ধু ব্রতচারীভুক্তি গ্রহণ করলেন এবং আস্তে আস্তে শিখে নিতে লাগলেন গুরুসদয় দত্তের আবিষ্কৃত যুদ্ধনৃত্য: রায়বেঁশে, ঢালী ও কাঠিনাচ। এই নৃত্যগুলো প্রশিক্ষণের সঙ্গে এগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্যও ব্যাখ্যা করা হতো শিক্ষণার্থীদের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর কিশোর মনকে দারুণভাবে নাড়া দিলো এই ব্রতচারীচর্চা। এদিকে ১৯৩৩ সালে বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হলেন বেরিবেরি রোগে এবং এই রোগ থেকেই তাঁর চোখে গ্লোকুমা নামের একটা রোগ দেখা দিলো। বছর তিনেকের জন্য মুজিবের লেখাপড়া স্থগিত হয়ে পড়ে।
১৯৩৫-৩৬ সালের দিকে শেখ মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান ভগ্নহূদয়ে মাদারীপুর থেকে গোপালগঞ্জে বদলি হয়ে এলেন। বন্ধু-বান্ধবদের পরামর্শক্রমে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে পুত্রের চোখে অস্ত্রোপচার করালেন। ফিরে এসে তাকে পঞ্চম শ্রেণীতে (Fifth Class) ভর্তি করালেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। প্রধান শিক্ষকের নাম গিরিশ বাবু। তিনি গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং স্কুলে ব্রতচারী প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি স্বয়ং। উল্লেখ্য, ইসলামিয়া হাইস্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় যখন ব্রতচারী চর্চায় শেখ মুজিবের হাতেখড়ি হয় তখন থেকেই ব্রতচারীনৃত্য ও ব্রতচারী সঙ্গীতগুলোর প্রতি তাঁর আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী ও স্কুলের ছেলেদের নিয়ে স্কুলের বাইরেও তিনি একটি ব্রতচারী দল গঠন করলেন এবং ব্রতচারী চর্চা, ভলিবল খেলা ও ফুটবল খেলা নিয়েই বেশিরভাগই সময় মেতে থাকতেন।
১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন তিনি ১৯ বছরের একজন পরিপূর্ণ যুবক ও দক্ষ ব্রতচারী। খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হয়ে দাঁড়ালো ব্রতচারীনৃত্য। তিনি বেশ কটি ব্রতচারীসঙ্গীত শিখেছিলেন। তম্মধ্যে: বাঙালি হ, আমরা বাঙালি, জয় সোনার বাংলার এবং বাংলাদেশ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর জীবনীকারগণ লিখেছেন- শরীরের গড়ন হ্যাংলা ও ছিপছিপে আর লম্বা হওয়ার কারণে ভলিবল খেলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী, তবে সবচেয়ে প্রিয় ছিল গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারীনৃত্য। এখান থেকেই তাঁর বাঙালি চরিত্রের উন্মেষ। অর্থাৎ পল্লীবাংলার দুর্গত মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিকদের দুরবস্থার উন্নয়ন চিন্তা, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা আর ধর্মনিরপেক্ষ সাম্যবাদী মানসিকতা তিনি ব্রতচারী আন্দোলন থেকেই লাভ করেছিলেন। এখানে একটা বিষয় গুরুত্বসহকারে উল্লেখ্য যে, ১৯৩৯ সালে গুরুসদয় দত্ত সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে শাশ্বত সোনার বাংলার একটি মানচিত্র প্রণয়ন করেন এবং বাঙলাদেশ নামে একটি অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে শেরে বাংলা, শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ বাঙালি নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে আলোচনা করেন। নেতারা গুরুসদয়ের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। বলাবাহুল্য যে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবটি ছিল মূলত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের একটি কৌশলী উদ্যোগ যা জিন্নাহর তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের প্যাঁচে পড়ে পাকিস্তান প্রস্তাবে পরিণত হয়। পুনরায় ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তিকালে সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসুর উত্থাপিত স্বাধীন যুক্তবাংলার দাবিও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের কবলে পড়ে ব্যর্থ হয়ে যায়।
১৯৪০ সালে ব্রতচারী শেখ মুজিব ছিলেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনই এলেন স্কুল পরিদর্শনে। তাঁরা উভয়েই কিন্তু ব্রতচারী আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। স্কুলের হোস্টেলের চাল মেরামত সংক্রান্ত একটি দাবি নিয়ে ব্রতচারী ছাত্রনেতা মুজিবের এক সাহসী প্রয়াস দেখে মন্ত্রীদ্বয় যারপরনাই মুগ্ধ হলেন। ব্রতচারী শেখ মুজিবের জীবনে আরেকটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটলো। দুর্ধর্ষ বাঙালি রাজনীতিবিদ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়ে গেলেন ব্রতচারী শেখ মুজিব। গুরুসদয়ের জাতীয়তাবাদী চেতনায় আপ্লুত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাতেই রাজনীতির জগতে অনুপ্রবেশ ঘটলো ব্রতচারী শেখ মুজিবের। ১৯৪১ সালের ২৫ জুন বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তির প্রেরণা এবং শেখ মুজিবের মাতৃভূমি প্রেমের দীক্ষাগুরু গুরুসদয় দত্তের মহাপ্রয়াণ ঘটে। কিন্তু ব্রতচারী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি।
১৯৪২ সালে শেখ মুজিব প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানেও গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের প্রভাব ছিল পুরোমাত্রায়। ব্রতচারী আন্দোলনের স্বদেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা হূদয়ে লালন করে শেখ মুজিব জড়িয়ে পড়লেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে। কলকাতায় গিয়ে নেতাজি সুভাষ বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনের কথা এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজির স্বদেশ ত্যাগের রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনার পর যুবক মুজিবের হূদয় নতুনভাবে শিহরিত হয়ে উঠলো। তিনি নেতাজির উডবার্ন পার্কের বাসায়ও যাতায়াত করতেন এবং নেতাজির অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ঘটে। ১৯৪৪ সালে মুজিব যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখন নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবসে কলকাতার বেকার হোস্টেলের অদূরে পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুস সালাম নামে জনৈক সুভাষ-প্রেমিকের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় নেতাজির কর্মকাণ্ডের প্রতি মুজিব আরও বেশি আকৃষ্ট হলেন। নেতাজির সংগ্রামী জীবন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্ব গাথা মুজিবের প্রতিবাদী হূদয়কে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। তখন থেকেই তিনি অনুধাবন করলেন যে, প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রতচারী আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
হাবিব আহমদ দত্ত চৌধুরী লিখেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী মোগলদের বিরুদ্ধে বীর বাঙালি সেনাপতি ঈশা খাঁর যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নেতাজির সশস্ত্র সংগ্রাম এবং বিপ্লবী নায়ক সূর্যসেনের সশস্ত্র বিপ্লব থেকে তিনি (শেখ মুজিব) বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করেছিলেন। অপরদিকে দুর্ধর্ষ রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে থেকে শিখেছিলেন সাংগঠনিক দক্ষতা ও নির্বাচনী কলাকৌশল আর পার্লামেন্টারি রাজনীতির সুচতুর পদক্ষেপগুলো। আর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন বক্তৃতার দেহাতি ভাষা। এসব গুণাবলীর সমন্বয়ে পাকিস্তানি শাসকচক্রের কবল থেকে মাতৃভূমি পূর্ববাংলার মুক্তির জন্য ২১৪ বছরের প্রান্তে তিনিই গড়ে উঠেছিলেন যোগ্যতম নেতৃত্বরূপে।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ব্রতচারী করা এবং নেতাজীর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিবের শৈশব থেকে খেলাধূলা, গান, ব্রতচারী ও সভা সমাবেশের প্রতি ছিল ভীষণ আকর্ষণ। দৈনিক আজাদ, আনন্দবাজার, বসুমতি, মোহাম্মদী, সওগাত ইত্যাদি সংবাদপত্র নিয়মিত পড়তেন। সমাজসেবামূলক কাজেও নিয়োজিত রেখেছিলেন নিজেকে। দুষ্টুমিতেও পিছিয়ে ছিলেন না মোটেও। রোগভোগের কারণে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়েছিলেন কয়েক বছর।
তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এসব বিষয়ে যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ১৯৩৪ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোটকালে তিনি খুবই দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবল, ভলিবল, হকি খেলতেন। তিনি গান গাইতেন এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতেন। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন এবং নেতাজী সুভাষ বসুর ভক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি লিখেছেন, ‘তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও, আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পরে শুনেছি’। ওপরের তথ্যের আলোকেই বলা যায়, কিশোর বয়সেই শেখ মুজিব তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া,
ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধই-কমার্স ব্যবসাকে মানুষের আস্থায় নিয়ে আসা উচিত
পরবর্তী নিবন্ধজুঁইদন্ডী ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী নৌকার প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট বর্জন