বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক স্বপ্ন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা : কতটা অগ্রসর হলাম আমরা

ডা. মাহফুজুর রহমান | শনিবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ আমলে বঙ্গবন্ধু যখন ছাত্র ছিলেন তখন ১৯৪৬ সালে দিল্লী মুসলিম লীগ সম্মেলনে বাংলাতে শ্লোগান দিতে দিতে দলবলসহ যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে পিকেটিং করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন এবং পরিষদ ভবন ঘেরাও করে আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলেন। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা জেল থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় তখন তিনি সেখানেও ছাত্রলীগের ছেলেদের সাথে বৈঠক করে ভাষা আন্দোলনে করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ৫৪ সালের নির্বাচনে যে ২১ দফা রচিত হয় তার অন্যতম কারিগর ছিলেন আবুল মনসুরসহ বঙ্গবন্ধু। ২১ দফা দাবির ১নং দাবি ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করা, ৯ নং দাবিতে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা ছিল, ১০ নং দাবিতে মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্থার উল্লেখ ছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বাইরে ও ভিতরে ২১ দফা বাস্তবায়নের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষার মুদ্রণের দাবি জানান। ৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি খসড়া শাসনতন্ত্রে সরকারি ভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ পূর্ব বঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোন ধোকাবাজি চলবে না। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা হোক।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তিনি সরকারি ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষার মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষার মানে দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাসহ সব কাজে বাংলার ব্যবহার হবে। এ দিন বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে তার বাস্তবায়ন ২০ বছর পিছিয়ে মানে ১৯৭৬ সালে করার কথা বলা হয়। বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে সমসাময়িক যে কোন নেতার চাইতে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অনেক বেশী।
১৯৬০ সালের শাসনতন্ত্রে আইয়ুব খান বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। কিন্তু ১৯৬০ সালে তিনি যে শরীফ কমিশন গঠন করেন তাতে বাংলা ভাষার রূপ ছিল ভিন্ন। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বলা হয়, উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করতে হবে, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করলে তা আরবীতে করা যুক্তিসংগত, উর্দু ও বাংলা বর্ণ মালা সংস্কার করে তা রোমান বর্ণমালায় অক্ষরান্ত করার চিন্তা করতে হবে, অবৈতনিক শিক্ষা তুলে দিতে হবে, শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি। আইয়ুব খানের শঠতার বিরুদ্ধে ৬২ সালে যে শিক্ষা আন্দোলন হয় তার অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৬৪ সালে গঠিত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন একই ধরনের রিপোর্ট দিয়ে শরীফ কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় তার অন্যতম শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধু অনুসারি ছাত্রলীগ এবং বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৯ সালের ১১ দফার ১/গ দাবিতে ছিল: শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ ও ‘হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট’ বাতিল করতে হবে এবং ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ১১ দফার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যে দিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করব, একেবারে শুদ্ধ বাংলা দিয়ে চালু করতে গেলে বাংলা ভাষা আর চালু করা যাবে না, প্রয়োজনে ভুল বাংলা দিয়েই চালু করব। পন্ডিতেরা ধীরে ধীরে তা সংশোধন করে দেবেন’।
’৭১ সালের ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহারে বাংলাদেশ অর্জনের যে তিনটি লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছিল তার প্রথমটি ছিল, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা সাহিত্য কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব গণপরিষদে যে সংবিধান পাশ করা হয় সেই সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে‘ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। আর বঙ্গবন্ধুর মতে, বাংলা কেবল সরকারি ভাষা নয়, রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রভাষার মানে হলে দেশের সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে। দেশের সব ধরনের শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে বাংলা। স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুসহ সবাই আশা করেছিলেন রাষ্ট্রের সকল স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে।
৭৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার বাণীতে বলেন, শহীদের আত্মাহুতি বৃথা যেতে দিব না, এই দিনটি জাতির আত্মশুদ্ধির দিন, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার জাতিকে সবক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাক এটা হোক কামনা।
৭৪ সালের ২৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলাভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে রাশিয়াতে গিয়েও বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অফিস আদালতে বাংলার প্রচলনের জন্য তিনি প্রচুর সংখ্যক বাংলা টাইপরাইটার কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে বাংলার প্রচলন হয়নি।
এর প্রেক্ষাপটে ৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারি অফিস আদালতের দাপ্তরিক কাজে বাংলাভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারী করেন, আদেশে বলা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা,বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা, তবু অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে, মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’এরপরও প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা বাংলা বিরোধী শক্তি বাংলা প্রচলন করেনি।
এরশাদ আমলে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলাভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। ১৯৮৭ সনের ২ নং আইনে বলা হয় * এই আইন বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ নামে অভিহিত হইবে৷ * ইহা অবিলম্বে বলবৎ হইবে৷
*এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। * কোন কর্ম স্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। * যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কাজের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে( সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়েছে)।
এরপরও বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটেনি এবং এই কারণে কোন মামলাও হয়নি।
অবশেষে একটি রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের আদেশে ‘দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে নির্দেশ দেন । এরপর সরকারি কাজে বাংলার প্রচলন ঘটলেও সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন ঘটেনি। অনেক সরকারি, আধা সরকারি অফিসেও এখনো পর্যন্ত ইংরেজির ব্যবহার চলছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলা ভাষা পুরোপুরি উপেক্ষিত। এমনকি রায় প্রদানকারি সর্বোচ্চ আদালতের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি।বলা চলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলা ভাষা ‘ সরকারি ভাষা’হিসেবে চালু রয়েছে তাও আবার পুরোপুরিভাবে চালু নেই।
আমাদের টেলিভিশনগুলো অবলীলায় সরকারি নির্দেশ ও আদালতের আদেশ অমান্য করছে । ঈযধহহবষ-ও, অঞঘ ইধহমষধ, অঞঘ ঘবংি, ঈযধহহবষ-৯, ইধহমষধ ারংরড়হ, ঈযধহহবষ-২৪, ঊঞঠ, জঞঠ, ঘঞঠ, গু ঞঠ, এঞঠসহ বেশ কিছু টিভির নাম শুধু মাত্র ইংরেজী অক্ষরে লেখা রয়েছে। পাশে বা উপরে বাংলা অক্ষর দিয়ে নামগুলো লেখা নেই। এগুলোর নামের অনুমোদন দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে চ্যানেলগুলোতে হরদম বিকৃত উচ্চারণে ইংরেজি বাংলার মিশ্রন ঘটিয়ে কথা বলা হচ্ছে।
নামফলক বা সাইনবোর্ডে ইংরেজির প্রাধান্য দিনে দিনে বাড়ছে। সরকারি যান বিআরটিসিসহ সব যানে ইংরেজির ছড়াছড়ি। খাবারের যে সব প্যাকেট করা হয় তার সবগুলোর উপর ইংরেজি ভাষায় পণ্যের নাম লেখা। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা অবহেলিত। দিন দিন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল বাড়ছে। সম্প্রতি আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশ দিয়েছেন যাতে বলা হয়েছে মাধ্যমিক স্থরের শিক্ষাথীদের তাদের ভর্তির ফরম ইংরেজিতে পূরণ করতে হবে। জালিয়াতির মাধ্যমে রেলওয়ের সিআরবিতে রেল কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষকে হাসপাতালের জন্য জমি বরাদ্দ দিয়ে যে চুক্তি করেছেন সেই চুক্তির ৪ টি ধারায় হাসপাতালের সব লেখালেখি ইংরেজিতে করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের প্রজ্ঞাপন ও রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি চুক্তির মাধ্যমেতো প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের সংবিধান , আইন, আদালতের নির্দেশকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করেছেন।
সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার হলো, বাংলাভাষা প্রচলন আইন লংঘন করার দায়ে ৮৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকারি কর্মকর্তার শাস্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সাধারণ চোর ডাকাত হাজারে হাজারে গ্রেফতার হলেও প্রকাশ্য রাজপথে আইন ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করে যারা ইংরেজিতে নামফলক টাঙ্গিয়ে রেখেছেন, নামফলকের উপরে বড় করে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করে নীচে ছোট করে বাংলা ভাষার ব্যবহার করে বাংলা ভাষাকে যারা প্রকাশ্যে ধর্ষণ করছেন তাদের কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে এমন উদাহরণ নেই। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাউকে কাউকে জরিমানা করেছেন এই যা দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বছরব্যাপী অসংখ্য অনুষ্ঠান হলেও কেউ রাষ্টের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে কোন কথা বলেননি। রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তা বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলে এক বছরের ভিতর পূরণ করতে পারেন। ইংরেজী সাইনবোর্ডগুলোকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ইংরেজি নামের পাশে বড় করে বাংলা ভাষায় নাম লেখার বাস্তবায়ন সরকারের একদিনের কাজ। আর উচ্চশিক্ষায় বাংলাভাষার প্রচলনে বছর খানেক সময় লাগবে। বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত সংবিধানে একমুখী গণমুখী প্রাথমিক শিক্ষাদানের যে কথা বলা আছে তার বাস্তবায়নে বড়জোর দু বছর লাগবে। বঙ্গবন্ধু জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি এই ব্যাপারে ছিল একেবারেই নিরব।
এই নিরবতা ভাঙ্গার সময় এসেছে। বাংলা ভাষা অত্যন্ত শক্তিশালি ভাষা। বাঙালি সংষ্কৃতি অসাম্প্রদায়িকতা লালনকারি সংষ্কৃতি। এই সংষ্কৃতি মানবতা শিক্ষা দেয়। পৃথিবীর কোন উন্নত রাষ্ট্র যেখানে তাদের দেশের জনগণের ভাষা ছেড়ে অন্যভাষা- শিক্ষার ক্ষেত্রে, অফিস আদালতের ক্ষেত্রে, নামফলক লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে না , তাদের দেশে কাজ করতে গেলে আমাদের সে দেশের ভাষা শিখে যেতে হয় সেখানে আমরা কিনা উন্নত ভাষা ও সংষ্কতি ছেড়ে ইংরেজি চর্চায় অব্যস্থ। ইংরেজিসহ অন্য ভাষা শিখতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। বরঞ্চ ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েরা ইংরেজিতে সব বিষয় পড়তে গিয়ে তিন চারগুণ সময় বেশি দিচ্ছে। বিদেশি ভাষা জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজির প্রাধান্য থাকায় দেশে শত শত ইংরেজি স্কুল গড়ে উঠছে। আমাদের সন্তানরা ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই সত্যগুলো আমাদের তুলে ধরার সময় এসেছে। রাজপথে নেমে সংবিধান, আইন, আদালতের নির্দেশ মেনে টেলিভিশন চ্যানেল,নাম ফলকে বাংলা ভাষার প্রাধান্য আনার, উচ্চ শিক্ষায় বাংলা প্রচলনের, সব সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহারের দাবি তুলতে হবে। এটাতো প্রমাণিত যে আইন, আদালতের নির্দেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মানছে না। না মানার কারণে কেউ বিচারের সম্মুখীনও হচ্ছে না। তাই জনগণকে রাজপথে নামা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অন্যতম স্বপ্ন – ‘রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলনের ’কোন সম্ভাবনা নেই। ২০১৮ সাল থেকেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে নামফলকে বাংলা ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজপথে নেমেছিল। তারা সেই ৬০ দশকের অনুকরণে ইংরেজি নামফলকের উপর কালিলেপন করেছিল। করোনার কারণে সেই কর্মসূচি বন্ধ ছিল। আবার বাংলা ‘ভাষা প্রচলন উদ্যোগ’ এর ব্যানারে তারা রাজপথে নেমেছে। ইংরেজি নামফলকগুলো বদলিয়ে নামফলকের উপরের ৬০ ভাগ বাংলায় ও নীচের ৪০ ভাগে প্রয়োজনে ইংরেজিতে লেখার আহ্বান জানাচ্ছে। সম্প্রতি মেয়রকে স্মারকলিপি দিয়েছে। মেয়র সব ব্যবসা সনদ (ট্রেড লাইসেন্স) দেয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলা ভাষায় লিখতে হবে বলে শর্ত দিয়েছেন। তার এই শর্তও প্রতিষ্ঠানগুলো মানছে না। মেয়র মহোদয় বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত বলেই সবার কাছে পরিচিত। দেখার বিষয় মেয়র মহোদয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন কি না। জানা গেছে মেয়র মহোদয় যথাযথ উদ্যোগ নিলে ‘বাংলা প্রচলন উদ্যোগ’ তাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানাবে। মেয়র মহোদয় উদ্যোগ না নিলে তারা নিজেরাই উদ্যোগ নিবে। তবে তাদের আশা মাননীয় মেয়র মহোদয় যথাযথ উদ্যোগ নিবেন, চট্টগ্রাম শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর নামফলকে বাংলা ভাষার প্রাধান্য আনবেন, বঙ্গবন্ধুর একটি স্বপ্নের প্রাথমিক ধাপ বাস্তবায়িত করবেন, মহাত্মা গান্ধীর সেই উক্তি ‘চট্টগ্রাম সবার আগে’ তা আবার প্রমাণ করবেন।
লেখক: চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধবিবাহ বিচ্ছেদ: দায় কেবল নারীরই?