আমাদের এই পৃথিবী সর্বত্র একই রকম নয়। এর কোথাও আছে বিস্তৃত সমভূমি, কোথাও আছে সুউচ্চ গিরিমালা, আবার কোথাও আছে উত্তপ্ত বালুরাশির বিশাল মরুভূমি। এখানে যেমন রয়েছে মিঠাপানির নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর, হ্রদ, তেমনই রয়েছে লবণাক্ত পানির সীমাহীন সাগর মহাসাগর। এর কোথাও সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা, আবার কোথাও নির্জলা, নিষ্ফলা কংকরময় মরুমালা। এর কোথাও সূর্যতাপে মাটি পুড়ে খাক হয়ে যায়, আবার কোথাও বরফে ঢাকা থাকে মাস-বছর-শতাব্দী ধরে। এ হলো আমাদের পৃথিবীর বিচিত্র পরিবেশীয় রূপ। পৃথিবীর এ বিচিত্র পরিবেশের প্রায় সর্বত্রই রয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণী। অনুমান করা হয় যে, বর্তমানে পৃথিবীতে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ এবং প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ১৩ লক্ষ। জীব বলতে অনুজীব, ছত্রাক, উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বুঝায়। পৃথিবীতে বিরাজমান জীব সমুহের সামগ্রিক সংখ্যা প্রাচুর্য ও ভিন্নতা হলো জীববৈচিত্র্য। অধ্যাপক হ্যামিল্টনের মতে-‘পৃথিবীর মাটি, পানি ও বায়ুতে বসবাসকারী সব উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবদের মধ্যে যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য দেখা যায় তাকেই জীববৈচিত্র্য বলে। যেকোনো দেশের জীববৈচিত্র্য সেই দেশের সম্পদ। Biodiversity এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো জীব বৈচিত্র্য। T. E.Lovejoy (1980) তারChanges in Biological diversity” প্রবন্ধে এবং E.A Norse and R. Gj McManus (১৯৮০) তাঁর ” Ecology and Living resources-Biological Diversity” প্রবন্ধে প্রথম Biological Divers শব্দ প্রয়োগ করেন। বিজ্ঞানী Wilson G.Rosen (১৯৮৬) সর্বপ্রথম Biological diversity এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে Bio-diversity শব্দটি ব্যবহার করেন। তাই দু’বারের Pulitzer পুরষ্কার বিজেতা Wilsonকে জীববৈচিত্র্যের জনক বলা হয়। মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধপত্র সহ যাবতীয় চাহিদা মেটাতে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের জন্যই মানুষ তার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম হয়। তেমনি প্রাণী প্রজাতি থেকে মাছ, মাংস, দুগ্ধ সামগ্রী, চামড়া, পালক, উল, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে। নির্মাণ সামগ্রী, বুনন সামগ্রী, ওষুধ, রঙ, মোম, কাগজশিল্প, কর্কশিল্প, রাবারশিল্প ইত্যাদি বহুধরনের সামগ্রী জীবজগৎ থেকে আসে। উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের জীবনযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের জীবকে সংযুক্ত করেছে। সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের সাথে তাদের সমৃদ্ধ জীবনযাপন নির্ভরশীল। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ জনগোষ্ঠীর সুন্দর জীবন যাপনের জন্য সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য দরকার। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পরিপাটি একটি মনোরম পরিবেশ মানুষকে দিয়ে থাকে অনাবিল আনন্দ, মানসিক শান্তি ও দৈহিক প্রশান্তি। মানসিক শান্তি মানুষকে করে চিন্তা মুক্ত, রোগ মুক্ত ও দীর্ঘজীবী। জীববৈচিত্র্য মানুষকে দেয় অনুপ্রেরণা, কাজে আনে নতুনত্ব। অনেকে অবসর সময়ে বাগান করে, পাখি পালন করে, অ্যাকুরিয়ামে সুন্দর মাছ চাষ করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নেও জীববৈচিত্র্যের রয়েছে প্রত্যক্ষ প্রভাব। বিশ্ব-অর্থনীতির ১১% এরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জীববৈচিত্র্যের পরিবেশ ও উৎপাদিত সামগ্রী। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে পর্যটকদের কারণে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। কেনিয়ার বার্ষিক আয়ের বেশির ভাগই আসে পর্যটন শিল্প থেকে। বাংলাদেশের পর্যটন ব্যবসাও বেশ সমৃদ্ধ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী দৃশ্যমান থাকায় ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ১৯৯৯ সালে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্বঐতিহ্যে যথাক্রমে ১১৩ প্রজাতির ম্যামালস, ১২৮ পাখি, ১২৬ রেপটাইলস, ২২ আম্ফিবিয়ান, ৭০৮ মৎস্য, ২৪৯৩ কীটপতঙ্গ, ১৯ মাইটস ও ১৬৪ প্রজাতির শৈবাল এবং ৩৩৪টিরও বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জলবায়ু পরিবর্তন, পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব, অপরিকল্পিত ভাবে গাছপালা নিধন,বনায়ন ধ্বংস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি কারণে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ১২টি বন্য প্রজাতি বিলুপ্ত।
বাংলাদেশ ৬৫০টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি বিলুপ্ত আর ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।৩৪টি উভচর প্রাণীর মধ্যে ৮টি,১৫৪ টি সরীসৃপের মধ্যে ১৪ টি প্রায় বিলুপ্তির পথে। যেমন – সুন্দরবন অঞ্চল থেকে বুনোমহিষ, সোয়াম্প হরিণ, হগ হরিণ, গণ্ডার, চিতা বাঘ ও গাউর পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কার্বন শোষণ ও ঘূর্ণিঝড়ের গতি প্রবাহ কমিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ‘পানি দুষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ জারি করেন। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একই বছরে জারি করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজার্ভেশন অর্ডার’-১৯৭৩। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ‘যৌথ নদী কমিশন’ গঠন করে প্রথম পানি কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু তার উন্নয়ন দর্শনে সোনার বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদকে গুরুত্ব দিয়ে ‘ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম’ ও ‘বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা’ গঠন করেন। যেটি রাবার ও কাঠ শিল্পকে টেকসই করা, পাহাড়ি ও গ্রামীণ জনপদে কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এদেশে তার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম শুরু হয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। সড়ক ও মহাসড়কের দু’পাশে সারি সারি গাছ লাগান, রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে সেখানে বৃক্ষ রোপণ করেন। গণভবন ও বঙ্গভবনে বৃক্ষরোপণ করে বাড়ির আঙিনা ও পতিত জমিতে গাছ লাগাতে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। মনোয়ারুল ইসলাম রচিত ‘বঙ্গবন্ধু কালের সীমানা ছাড়িয়ে’ -গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু পরিবেশ রক্ষার জন্য চর কুকরি-মুকরি এবং নিঝুম দ্বীপ ও সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। সুন্দরবনের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও গবেষণায় এই অভয়ারণ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বঙ্গবন্ধুর করা আইনের উপর ভিত্তি করে আজো দেশের পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা টিকে আছে। তারই নির্দেশিত পথে বর্তমান সরকার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে সংবিধানে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি অ্যাক্ট-২০১৭ পাস হয়েছে। এই আইনে ৫ শতাংশের বেশি জায়গা ‘ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল’ এরিয়া হিসেবে সংরক্ষিত রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে এইআইনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্য রোধে বন বিভাগের অধীনে ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট গঠন করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সক্ষমতা বাড়াতে শেখ কামাল বন্যপ্রাণী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামবাংলায় জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ আয়োজিত ‘বায়োডাইভারসিটি সামিট’ এ টেকসই উন্নয়নে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। যদি জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়া অব্যাহত থাকে তাহলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তির পাশাপাশি মানুষও বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার আশংকা রয়েছে। কেননা জীববৈচিত্র্য ছাড়া মানবজাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেক জীবের এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব প্রকৃতির ঘোষণা পত্রে এ চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য প্রতিটি প্রজাতির জীবকে বাঁচিয়ে রাখা। এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। এ প্রসঙ্গে ভারতের হিমালয় অঞ্চলের ‘চিপকো’ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়। চিপকো স্থানীয় আদিবাসী শব্দ। যার অর্থ হলো-লেপ্টে থাকা। কোনো বৃক্ষ কাটতে এলে ওই আন্দোলনের কর্মীরা গাছের সাথে লেপ্টে থাকে। ফলে ওই গাছটি কাটার হাত থেকে রক্ষা পায়। স্থানীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমাদেরও অবস্থা অনুযায়ী কোনো উপায় আবিষ্কার করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।