নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | রবিবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

নৈতিকতা মানুষের জীবনের অন্তর্নিহিত গুণাবলী যা মানুষকে নীতিজ্ঞান আহরণের মাধ্যমে বাস্তব জীবন বোধ লাভে প্রেরণা জোগায়। এটি মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব বোধ ও নীতি সম্পর্কিত ধারণা বা বোধ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ইংরেজ দার্শনিক হারবার্ট স্পেনসার বলেছেন ‘নৈতিকতা ভৌগোলিক পরিমণ্ডল কিংবা জাতিগত বৈষম্য মানে না’। সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার লক্ষ্যে মানুষকে কিছু নিয়ম নীতি মনেপ্রাণে ধারণ করে সচেতনতার সাথে এগিয়ে যেতে হয়। এসব নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি মানুষকে নানাবিধ নতুন জ্ঞানার্জনে সহায়তা করে। আর এসব নিয়ম নীতি প্রকৃষ্টভাবে মেনে চলার ক্ষেত্রে সুন্দর মানসিকতা, আগ্রহবোধ ও নীতির যথার্থ আচরণ হলো নৈতিকতা।

মানুষের জীবনে মনুষ্যত্ব বোধ ও বিবেকবোধের সাথে নৈতিকতার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রাণী জগতের সকল সৃষ্ট প্রাণীর তুলনায় মানুষের জীবনে একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য আছে বিধায় মানুষকে মনুষ্যত্ব বোধ অর্জনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এই মনুষ্যত্ব বোধ অর্জনের প্রয়াস মানুষকে বিশেষ কিছু গুণাবলী অর্জনে অনুপ্রাণিত করে। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন ‘যদি প্রত্যেকে ভালো কাজ না করে, আমি নিজে ভালো কাজ করবো। যদি প্রত্যেকে খারাপ কাজ করে, আমি নিজে খারাপ কাজ করবো না’। এই কাঙ্ক্ষিত গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায় -অন্যায়, সুনীতি-দুর্নীতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে সমর্থ হয়।

নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দেয়। কাজেই এটি সকলের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় জীবন বিধি যা মানুষের জীবন ব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতিকে অভিনবত্বের আলোকে মহিমান্বিত করে। নৈতিকতা ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বিষয়ে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন ‘গুরুত্বপূর্ণ মানবিক প্রচেষ্টা হচ্ছে আমাদের কর্মের মাঝে নৈতিকতার প্রকাশ ঘটানো’। নৈতিকতা আমাদেরকে অনৈতিক কর্মপন্থা থেকে বিরত থাকতে সহায়তা করে, স্বার্থপরতা থেকে দূরে সরিয়ে ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে প্রেরণা জোগায়। ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি বলেছেন ‘নৈতিকতার নামে অনৈতিক কাজ করানো সম্পূর্ণ গর্হিত কাজ’। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তিরা দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত বিধায় তারা অন্যায়, অনৈতিক ও অবৈধ পন্থায় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘৃণিত কাজে জড়িয়ে পড়ে।

নৈতিক মূল্যবোধ মানব জীবনকে সুন্দর ও সুষমা মণ্ডিত করে তোলে। ফরাসি লেখক ভিক্টোর হুগো বলেছেন ‘সত্যের পরিপূর্ণ বিকাশই নৈতিকতা’। মিথ্যাকে মনেপ্রাণে পরিহার করে সত্য, ন্যায় ও আদর্শিক জীবন পরিচালনার মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মূল্যবোধের স্বচ্ছ প্রয়োগ ও আদর্শিক প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। নৈতিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যবান সম্পদ এবং এ ধরনের গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা সমাজে যত বেশি বৃদ্ধি পাবে সমাজ ততোধিক উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। চারিত্রিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনে নৈতিক মূল্যবোধ লালন ও চর্চা করার খুবই প্রয়োজন। নৈতিকতার মূল্যায়ন সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য সর্বপ্রথম আমাদেরকে নীতিজ্ঞান কী তা বুঝতে হবে। এককথায় সমাজ জীবনে সকল মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে ইতিবাচক জীবন চর্চার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম নীতিই হলো নীতিজ্ঞান। সময়ের বিবর্তনে সমাজ জীবনে যুগে যুগে বংশ পরম্পরায় যেসব নৈতিক আদর্শ গড়ে উঠে সেসব আদর্শ সমাজকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে সহায়তা করে। সমাজ বদ্ধ মানুষ যখন এসব নিয়ম নীতির উপর আস্থাশীল থাকে তখনই সমাজ আদর্শিক নিয়মে সুসংগঠিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় মানুষের মাঝে নীতির আলোকে নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিকতা বোধের ধারণা অনুভূত হয় যা মানুষকে নৈতিকতা বোধে উজ্জীবিত হতে প্রেরণা জোগায়।

তাই নৈতিকতার কথা আলোচনা করতে গেলে মূল্যবোধের কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে যায়। আসলে কিন্তু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এক নয়। নৈতিক আদর্শ পালনের মাধ্যমে সৎ ও আদর্শিক জীবন যাপনের সাহায্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি হতে পারে। মানুষের অন্তরে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটলে মানুষ নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হয়। অপরপক্ষে মূল্যবোধহীনতা মানুষের জীবনকে ব্যর্থতায় নিমজ্জিত করে। নৈতিকতার সঠিক অনুশীলন বা অনুসরণ ব্যতীত মানুষের জীবনে মূল্যবোধ গড়ে উঠতে পারে না। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধের প্রভাব যতই সমুজ্জ্বল সেক্ষেত্রে ব্যক্তি, সমাজ ও রাস্ট্র নৈতিকতার আদর্শে ততই উন্নত ও ঋদ্ধ। মূল্যবোধ হীন সমাজে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মানবিকতা বিবর্জিত কৃত্রিম ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজ ও রাষ্ট্র নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আদর্শে পরিচালিত না হলে সমাজ রাষ্ট্রের চলমান প্রক্রিয়া সর্বক্ষেত্রে নির্জীব ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। মানুষের মাঝে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে তাদেরকে সর্বাগ্রেই নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নৈতিকতা বিষয়ক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

কালের বিবর্তন ধারায় পরিবর্তিত হচ্ছে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বোধ। অন্যায়, অসত্য, নীতিহীনতা, লোভ, লালসা মানুষের বিবেকবোধকে যত বেশি গ্রাস করেছে মানুষের জীবন থেকে মূল্যবোধের ধারণা ততই বিলুপ্ত হতে চলেছে। বর্তমান সমাজে স্বার্থপরতা, অহংবোধ, আত্মপ্রতিষ্ঠার অনৈতিক প্রতিযোগিতা মানুষকে নীতি নৈতিকতা বোধ শূন্য করে তুলেছে। এটি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম একটি প্রধান কারণ। সর্বগ্রাসী ভোগ বাসনা মানুষকে ক্রমান্বয়ে মূল্যবোধ হীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তথাগত বুদ্ধের মতে আকাঙ্ক্ষার উৎপত্তিতেই দুঃখের কারণ। এই আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা থেকে সৃষ্টি হয় লোভ এবং এই লোভই মানুষকে ভোগ বাসনার দিকে ধাবিত করে। আর তখনই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ নীতি নৈতিকতা হারিয়ে মূল্যবোধ হীনতার অন্ধ গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।

বর্তমান সমাজে অধিকাংশ নীতি বিবর্জিত ব্যক্তিরা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। সেই ব্যক্তিস্বার্থের পিছনে রয়েছে লোভ লালসা ও ভোগের মনোবৃত্তি যা নীতি নৈতিকতা বোধ হীনতায় পর্যবসিত হয়। এই নীতিহীনতা মানুষকে বিবেক বর্জিত করে অন্যায়, অনৈতিকতা ও দুর্নীতির সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে। সংগত কারণেই মূল্যবোধ হীন মানসিকতার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় জনিত কারণে সমাজে ও বিশ্বে জন্ম নিচ্ছে অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি ও বিধ্বংসী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। মূল্যবোধহীনতা এমন এক নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যার ফলশ্রুতিতে মানুষের মধ্যে আন্তরিক হার্দিক সম্পর্ক টুকু কৃত্রিম যান্ত্রিকতার মাপ কাঠিতে মূল্যায়িত হচ্ছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মূল্যবোধহীনতা ব্যাপক ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে চলেছে। কাজেই বর্তমান সমাজের ক্রমবর্ধমান সমস্যাসমূহ মূল্যবোধহীনতার মধ্যে নিহিত। এসব সমস্যা সমূহ শেকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে না পারলে মূল শোচনীয় অবস্থা থেকে উত্তরণের বা মুক্তির কোনো সহজ উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। মূল্যবোধের বাস্তব উপলব্ধি প্রকাশের লক্ষ্যে সর্বাগ্রে সকলকেই যুগপৎভাবে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানসিকতার উন্মেষ ঘটাতে পারলেই সমাজ জীবনের সব সমস্যা দূরীভূত হবে এবং সমাজে ন্যায় বোধ, বিবেকবোধ, সৌজন্যবোধ ও মনুষ্যত্ব বোধ প্রতিষ্ঠিত হবে। নৈতিক শিক্ষার অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মায় মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটানো যাবে এবং মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। আসুন, সকলে মূল্যবোধের প্রসারে নৈতিক শিক্ষার আলোকে নিজের জীবনকে আলোকিত করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের ধারণা এবং জ্ঞানার্জনে উদ্বুদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর পরিবেশ ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধপলোগ্রাউন্ডের সমাবেশ উপলক্ষে প্রস্তুতি সভা