বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণ

রাশেদ রউফ | বুধবার , ৩ আগস্ট, ২০২২ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি নাম, যাঁর অঙ্গুলি হেলনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিজেদের জীবন চালিত করেছে একাত্তরে। ‘যে নাম উচ্চারিত হয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে, প্রতিটি মানুষের মনে মনে। তরঙ্গায়িত হতে হতে ছুঁয়ে গেছে বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়, মন ও মনন’। আমাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন পর্বতপ্রমাণ অটল ব্যক্তিত্ব। তাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্ব এবং সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেছিল। যার ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিকাশ ঘটেছে বাঙালি জাতিসত্তার।

চিন্তাশক্তির প্রখরতা, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নেতৃত্বকে নানাজন নানাভাবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের বিশ্লেষণটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।

১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ফ্রস্টের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু সাতটি বাক্যে নেতৃত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে-‘সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ এক দিনে হঠাৎ করেই নেতা হতে পারেন না। এটা অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাঁকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, তিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। মানবতার জন্য আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তাঁর মধ্যে অবশ্যই নীতি-আদর্শ থাকতে হবে। যদি কোনো নেতার এসব গুণ থাকে, তবে তিনি নেতা।’ এই সাতটি বাক্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে একজন মানুষের নেতা হওয়ার জন্য অনুসরণযোগ্য সব উপাদান। এই বিশ্লেষণ আসলে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন নির্ভীক, দয়ালু এবং পরোপকারী। স্কুলে পড়ার সময়েই নেতৃত্বের গুণাবলি ফুটে ওঠে তাঁর মধ্যে। ছাত্রাবস্থায়ই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ক্যারিসমেটিক সেনস অব পলিটিকস বা ক্যারিসমেটিক রাজনীতি বোধের প্রকাশ দেখা যায়। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অধিকার আদায়ের শেষ আশ্রয়স্থল। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ বরেণ্য নেতার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৮ সালে তার প্রস্তাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তিনি বার বার কারারুদ্ধ হন। কখনো জেলে থেকে কখনো বা জেলের বাইরে থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত আন্দোলন-বিদ্রোহে কারান্তরীণ অবস্থায় থেকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ‘৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাহসী, কৌশলী, সৎ, ত্যাগী, ধর্মনিরপেক্ষ, অনলবর্ষী বক্তা ও যোগাযোগকারী, ভিশনারি, মানবিক নেতা। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে তাঁর নেতৃত্ব বিকশিত হয় এইসব অসাধারণ গুণের কারণে। তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের ক্যারিসমেটিক নেতাদের একজন। টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সংখ্যায় বলা হয়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অর্ধশতাব্দীজুড়ে যাঁরা ক্যারিসমেটিক হিসেবে আলোচিত তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওয়াহেরলাল নেহরু। এই তালিকায় সম্ভবত আরেকটি নাম যোগ হতে যাচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।’ বিশ্বের খ্যাতনামা এনসাইক্লোপিডিয়াডটকমে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ক্যারিসমেটিক নেতা শেখ মুজিব তৃতীয় বিশ্বে উপনিবেশবিরোধী নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।’
বাসসের সাবেক সিটি এডিটর অজিত কুমার সরকার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মাঝে মানুষকে আকৃষ্ট করার মোহনীয় শক্তি ছিল। … তিনি শুধু ভালো বক্তা নন, ভালো একজন যোগাযোগকারীও। যোগাযোগবিদ্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি প্রকৃত অর্থে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগে সহজ ভাষা ব্যবহার করতেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা তিনি এমনভাবে তুলে ধরতেন যে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠত। ভালো বক্তৃতা ও যোগাযোগকারীর গুণ থাকার কারণে তিনি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন।’ [বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বিশ্ব মিডিয়া, যুগান্তর, ১ আগস্ট ২০২১]
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী ও কৌশলী। পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন। ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের এক লেখায় পাই : ‘১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে ২৪নং নম্বর কক্ষে থাকতেন। সেখানে একদিন তিনি বিছানার ওপর বসে, চারজন সঙ্গী নিয়ে পাকিস্তান নিয়ে বেশ কিছু কথা বললেন। প্রথম কথাটি ছিল এই যে, এ পাকিস্তান যে পাকিস্তানের জন্য তিনিও লড়াই করেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য হিসাবে, সে পাকিস্তান এ পাকিস্তান নয়। লাহোর প্রস্তাবের বিকৃতি হিসাবে পাকিস্তানের উদ্ভব হলো। কাজেই এ পাকিস্তান বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করবে না। তার স্পষ্ট কথা তিনি তখনই বলে দিলেন। সুতরাং ঢাকায় ফিরে গিয়ে নতুন করে বাঙালির জন্য আন্দোলন শুরু করতে হবে। দ্বিতীয় কথাটি মেঠো বাংলায় বললেন ‘ঐ মাউড়াদের সঙ্গে বেশিদিন থাকা যাবে না’। কী চমৎকার ঐতিহাসিক মন্তব্য! মেঠো বাংলায়, অবাঙালি ওই পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালিরা বেশি দিন থাকতে পারবে না। সত্যিই তারা থাকেনি। বাঙালি থেকেছিল ২৪ বছর ৪ মাস তিন দিন। সে জন্যই ১৯৭২-এ অন্নদাশংকর রায় বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন আপনি কবে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় বলেছিলেন ১৯৪৭ থেকে। ইতিহাসও তাই বলে।’

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার উদাহরণের জন্য আরেকটি ঘটনার কথা এখানে তুলে ধরছি। ১৯৬৮ তে বঙ্গবন্ধু তখন আগরতলা মামলার আসামি। একদিন তাঁকে বাসযোগে সামরিক আদালতে নেওয়া হচ্ছে। তখন তার সঙ্গে ছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত আসামি বর্তমানে প্রয়াত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ভূতপূর্ব ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। তিনি বিমর্ষভাবে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করলেন যে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, এ বিচার করতে পারবে না পাকিস্তানিরা। জনরোষের কারণে এ বিচার বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর পাকিস্তান সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করবে; কিন্তু ক্ষমতা পাবে না। তারপরই শুরু হবে হৈ-হট্টগোল।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন লিখলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন-হৈ, হট্টগোল। আপনারা লক্ষ করুন, বঙ্গবন্ধু ঠিক যেভাবে বলেছেন সেভাবেই ঘটনাপ্রবাহ পরিচালিত হয়েছে। স্বপ্নের ঠিকানা তিনি কীভাবে নির্মাণ করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু জ্যোতিষী ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অতীন্দ্রিয় চেতনা বেশি পরিমাণে ছিল।’
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনে সততাই ছিল মূল চালিকাশক্তি। এই সততার শিক্ষা তিনি পেয়েছেন পরিবার থেকে। সারাটি জীবন তিনি এই সততাকে লালন করেছেন, করেছেন অনুশীলন। রাজনীতিতেও তিনি কখনো মিথ্যা বা ভণ্ডামির আশ্রয় নেননি। ফলে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘আনডিসপুটেড লিডার অব দ্য বেংগলিস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘নো ওয়ান অ্যাকিউসড শেখ মুজিব অব ফলস মডেস্টি।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে দুদকের গণশুনানি আজ
পরবর্তী নিবন্ধসাতশ একর ভূমি উদ্ধার