বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার দর্শনের কথা যদি লিখতে হয় তাহলে তার প্রায় ৩০৫৩ দিনের কারাবাসের মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়েছি অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজ নামচা নামের দুটি গ্রন্থ, অন্য দিকে বাকিগুলো হলো, তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতি এবং দেশ ও মানুষ নিয়ে তাঁর কথোপকথন। বঙ্গবন্ধুর মূল ভাবনার মধ্যে ছিলো, মানুষের উন্নয়ন কোন গোষ্ঠী বিশেষের উন্নয়ন নয়।
স্বাধীনতা, যুদ্ধকালীন মূল্যবোধ, জাতীয় চৈতন্যের জাগরণ, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ এবং আকাঙ্ক্ষা, মাতৃভূমির চেতনা, প্রগতিশীল নীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে তিনি শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা করতে চেয়েছিলেন। সকল অশুভ শক্তিকে দু’পায়ে মাড়িয়ে, সকল চক্রান্ত রুখে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক গভীর দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য। বাংলাদেশকে শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির উঁচুস্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি বলতেন, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকুরি বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার মাটি, মানুষ আর প্রকৃতির কাছে ফিরে এসেছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে, এসেই বলেন, আমি আপনাদের কাছে দু-একটি কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তিতা করতে পারবোনা। ১৯৭২ সালে প্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রস্তুত করা হয়েছিল সেখানে তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর আমাদের রিজার্ভ এ কোন বৈদেশিক মুদ্রা ছিলো না। আশি ভাগ মানুষ দরিদ্র এবং ক্ষুধার্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যসঙ্কট, মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য শান্তি আবশ্যক’। পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তি লাভ করে বাংলাদেশে এসে প্রথমে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, পরে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মান সূচক ‘জুলি ও কুরি’ পদক লাভ করেন ১০ অক্টোবর ১৯৭২ সালে। স্বাধীন হবার পর একটি দেশের দুটো কাজ থাকে- রাষ্ট্রগঠন এবং জাতিগঠন, তিনি তা শুরু করেছিলেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পরে বঙ্গবন্ধু কৃষি ক্ষেত্রে, শিল্প ও অবকাঠামোসহ দেশের অর্থনৈতিক খাতে বিপ্লব ঘটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের যাত্রা শুরু করেছিলেন। জল এবং জনশক্তিকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং পাবলিক কূটনীতি সম্পর্কে ছিলো তাঁর নিজস্ব ভাবনা। যোগাযোগ, পরিবহন, বন্দর এবং জ্বালানি খাতে তিনি দ্রুত রূপান্তর ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, খাদ্য ও চালের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ন্যায়-বিচার, শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ-বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে তিনি মূলত একটি প্রতীকে পরিণত হন। পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়, আন্তর্জাতিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠন, সম্পদ ও প্রযুক্তির ন্যায় সঙ্গত ভাগাভাগি, অন্তর্ভুক্তি, সংকল্পের অধিকার, অন্যায় ও নিপীড়ন, আয়ের বৈষম্য এবং বঞ্চনা, মানবিক সংগতি, মানবাধিকার, মানুষের কল্যাণ, আন্তর্জাতিক সামঞ্জস্যতা এবং আত্মনির্ভরতা, ভালো প্রতিবেশী সম্পর্ক, সুষ্ঠু খেলাধুলার চেতনা, পুরুষ ও মহিলাদের অদম্য চেতনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্ব নিয়ে তার অসংখ্য ভাবনার কথা আমরা ইতিহাস পঠনের মাধ্যমে জানতে পারি। প্রাসঙ্গিক ভাবনা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সালের সময়কাল বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই যে তিনি যখন প্রাদেশিক পরিষদের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ১৫০ টি বৃহৎ শিল্প ইউনিটের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলো, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের ৪৭টি বৃহৎ শিল্প ইউনিটের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র দুই কোটি টাকা। এ সময় তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, প্রাদেশিক সরকার আমদানি লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতা পাবে। পাট তুলা ও তৈরি পোশাকের মতো শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। আমদানি-রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় স্থাপিত হবে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে। সাপ্লাই এবং ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালকের একটি পৃথক কার্যালয় পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হবে। শতকরা ৫০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে (যা আগে যা ছিল কেবল দশ ভাগ)। তিনি কেন্দ্রীয় চা বোর্ডের সভাপতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক চা শিল্পের বিকাশে তৎপর ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাঠে নজর দিলে আমরা দেখব, তিনি ছিলেন একজন আত্মমর্যাদাশীল নেতা এবং রাজনীতিবিদ। ১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট পিটার বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না পেলে বাংলাদেশের জনগণ কি খাবে? তখন তিনি জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দেখিয়ে পিটারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি বাইরে কি দেখতে পাচ্ছেন’? তিনি বলেছিলেন, ‘সবুজ গাছের একটি সুন্দর উঠোন’। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি আপনারা কোন ধরনের সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে আমার জনগণ এগুলো খাবে’।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা ছিলো তিন স্তরভিত্তিক (জেলা, থানা এবং গ্রাম) প্রশাসন ব্যবস্থার, লক্ষ্য হবে রাজধানী কেন্দ্রীভূত, ক্ষমতা ও সম্পদকে প্রত্যন্ত এলাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা, যেখানে স্থানীয় উন্নয়নের প্রভৃত কাজকর্ম চালু থাকবে। গ্রাম উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন, মেহনতী মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার স্বপ্ন ছিল তাঁর। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গ্রাম উন্নয়নের এক সামষ্টিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। যার মধ্যে ছিল চাষাবাদ পদ্ধতি আধুনিকায়ন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রাম-সমবায় ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কুটির শিল্প স্থাপন এবং কৃষকের জন্য শস্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা। শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য শিল্প কারখানা, ব্যাংক-বীমা, টেঙটাইল মিল, কাগজ কল, পাটকল, সার কারখানা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের একাংশ জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসা, এছাড়া ১৩৩টি কারখানাকে ব্যক্তিখাতে হস্তান্তরও করেছিলেন। রফতানি বৃদ্ধিকল্পে প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির পদক্ষেপও নেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত, মানসম্মত ও বাস্তবমুখী করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানী ডঃ কুদরাত-ই-খুদা নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ১৯ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না’। জাতীয় উন্নয়নের শতকরা চার ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন। ১৯৭৩ সালে দেশের ৩৬১৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করা হয় এছাড়া প্রায় ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকুরি সরকারিকরন করা হয়, অল্প সময়ে ৫৪ হাজার নতুন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করেন, ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেন, দেশের পাঁচটি সরকারি কলেজের মানোন্নয়ন করে সেগুলোকে ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ এ রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয় আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি নতুন ব্যবস’ার ভিত রচনা আর জন্য পুরনো সমাজ ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়বো’। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের মূল একক হবে গ্রাম। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত গ্রাম সরকার স্থানীয়ভাবে কর সংগ্রহ করতে পারবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ হবে গ্রামীণ জনশক্তির ব্যবহার, ভূমি সংস্কার, চাষাবাদ সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, কৃষিশিল্পের সম্প্রসারণ তিনি চেয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের এবং গ্রাম সরকারের সঙ্গে শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনা। পাকিস্তান আমলে কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দশ হাজার সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং রেশন সুবিধা প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট এটা তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছিলেন সকল দেশের সকল সমাজের সকল নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত-বঞ্চিত, মেহনতী মানুষের মহান নেতা। মুক্তির মিছিলে, যুদ্ধ ভূমিতে, কারাগারের অন্ধকূপে, ফাঁসির মঞ্চে আমরা তাঁকে দেখেছি। তিনি সংগ্রাম করেছেন সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা পুরাতন পঁচা সনাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজন্ম এক প্রতিবাদী মহান নেতা। শেলীর ভাষায় যদি লিখি তাহলে লিখতে হয়, ‘সে বেঁচে আছে, সে জেগে আছে।মানুষের ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয় হয়ে আছে’।
কালের চিরন্তর বেলায় তাঁর নীতি আদর্শ ও মূল্যবোধ তাঁকে দিয়েছে অমরত্তের গৌরব। বীরের মত মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যিশুখ্রিস্টের মত, মহাত্মা গান্ধীর মত। ঘাতক হরণ করতে পারেনি তাঁর আত্মমর্যাদা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় চার বছরের অভিজ্ঞতা নিদারুন। পরাজিত ও দেশবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র ছিল প্রতিনিয়ত। এ কারণেই হয়তো বঙ্গবন্ধু ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামোর পরিবর্তন চেয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন গোঠা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সাম্রাজ্যবাদী চক্র মেনে নেয়নি দরিদ্র বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার প্রস্তুতি পর্বকে; বিভক্তি ও বিভাজনের দেয়াল তৈরীর মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে হারালাম। এই শূন্যতা আর কোনদিন পূরন হবে না। ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা দেখবো- কেউ কেউ এই ইতিহাসের বিবরণ লিখেন আর কেউ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন এবং ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু মূলত ছিলেন তেমন একজন মহান মানুষ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক