নাম সর্বস্ব পেইজ খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইতোপূর্বে শোভা পেত বিভিন্ন পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন। আর তাতে অর্ডার করলেই প্রতারিত হতেন গ্রাহক। প্রতিদিন এমন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে লোপাট গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা। হয়রানির হাতিয়ার ফেসবুক এখন আরও একধাপ এগিয়ে হয়ে উঠেছে অপরাধের অন্যতম হাতিয়ার। তাদের ধরতে অভিযানে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের।
কিডনি ও লিভার ডোনেশনের ব্যবসা : কিডনি ডোনেট সেন্টারের নামে ফেসবুকে পেইজ খুলে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে ভারতে পাচার করা হয়– এমন একটি চক্রের মূলহোতা ধরা পড়ে র্যাবের হাতে। ৩০ ডিসেম্বর নগরীর খুলশী এলাকা থেকে চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব–৭, চট্টগ্রাম। ফেসবুকে পেইজ খুলে ডোনারদের নানাভাবে কিডনি ও লিভার ডোনেশনের ব্যাপারে প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর ঢাকার একটি হাসপাতালে তাদের রক্ত, কিডনি ও লিভার পরীক্ষা করানো হয়। রিপোর্ট ঠিক থাকলে ঐ লোকদের তারা ইন্ডিয়াতে পাচার করে।
র্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, ভারতে ডোনারদের সাথে রোগীদের রক্ত, কিডনি ও লিভার ক্রস ম্যাচ করিয়ে থাকে তারা। শুধু কিডনি ও লিভারের জন্য চক্রটি রোগীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু কিডনি দাতা বা লিভার দাতাকে দেন মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। ভারতে অবস্থানরত এ চক্রের অন্যতম মাথা শাহিন ওই দেশের হাসপাতালে ভিকটিমদের বিভিন্ন অঙ্গের পুনরায় পরীক্ষা করানোর পর তাদের কাছ থেকে কিডনি ও লিভার সংগ্রহের ব্যবস্থা করে।
‘বিশেষ অফার’ দিয়ে জাল নোট বিক্রি : বিশেষ অফার দিয়ে ফেসবুকসহ অনলাইনে বিভিন্নভাবে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট। অগ্রিম অর্ডার নিয়ে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এজেন্টদের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে হোম ডেলিভারিও। আইনশৃক্সখলা বাহিনীর তথ্যমতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে জাল টাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি চক্র। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে জাল নোট সরবরাহের জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করা হচ্ছে। যে কেউ এসব গ্রুপে যুক্ত হতে পারছে। গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন তথ্য আদান–প্রদান হচ্ছে। ফেসবুক থেকে পরে অনেককে সরাসরি যুক্ত করা হচ্ছে জাল নোট ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন এনক্রিপ্টেড অ্যাপে।
পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা : গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা করে আসা একটি চক্রের মূলহোতাসহ তিন জনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে যশোর কোতোয়ালী থানা পুলিশ। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল ইমরান জানান, ফেসবুক এখন অপরাধের খুব সহজ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের বিজ্ঞাপন ডাউনলোড করে সেখানে নিজেদের মোবাইল নম্বর বসিয়ে অনলাইনে আপলোড দিতেন তারা। পরে গ্রাহক তাদেরকে কল করলে তারা নিজেদেরকে সেলস ম্যানেজার পরিচয় দিতেন। পণ্য বিক্রি করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। পরে আসল পণ্যের পরিবর্তে গ্রাহককে দিতেন ভেজাল পণ্য। চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের থেকে বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহৃত ১২টি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ২২টি বাটন ফোন, ৩টি কম্পিউটার, ৬টি পেনড্রাইভ, একটি ডিভিআর, একটি ডিভিডি রাইটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশ। চলতি মাসে তারা ২৩ লাখ টাকা বিকাশে লেনদেন করেছে।
ফেসবুকে চোরাই মোটরসাইকেল বেচাকেনা : গত ১ মে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ যুবককে গ্রেপ্তার করে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের থেকে উদ্ধার করা হয় ১০টি মোটরসাইকেল। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার (উত্তর) তাইয়ান আদনান নিহাদ জানান এই যুবকেরা চুরি ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে মোটরসাইকেল বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত মাজেদ উদ্দিন নাদিমের ফেসবুকে ‘এন কে মোটরস’ ও ‘অভ্রনীল নাদিম’ নামে আলাদা দুটি পেইজ আছে। এসব পেইজে পাঠাওয়ের মাধ্যমে চালানোর কথা বলে মোটরসাইকেল ভাড়া নেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। সেই বিজ্ঞাপন দেখে কেউ কেউ তার নিজস্ব মোটরসাইকেল নাদিমকে ভাড়া দিতেন। কয়েকটি মোটরসাইকেল নেয়ার পর নাদিম সেখান থেকে দুয়েকটি জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দিত। নগরীর বিভিন্ন থানায় এই প্রক্রিয়ায় মোটরসাইকেল হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তিনটি মামলা আছে। আবার চুরি করা মোটরসাইকেলও তারা সংগ্রহ করত। সেই মোটরসাইকেল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো ফেসবুকের পেইজগুলোতে। পরে সেগুলো চোরাই বাজারে বিক্রি করতো। নাদিমের নামে ফেসবুকের পেইজ খোলা হলেও ছয় জনের পুরো চক্রটিই এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এর আগে চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রি করতে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ধরা পড়ার ঘটনা ঘটেছে নগরীতে।
জানা যায়, রাঙামাটি বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের উপ–সহকারী প্রকৌশলী এরশাদ আলীর মোটরসাইকেল (রাঙামাটি– ল ১১–০৭৪৩) গত ১২ জানুয়ারি চুরি হয় নিজের বাসা থেকে। এর আগে একই বিল্ডিং থেকে ভবন মালিক রত্নাকর চাকমার মোটরসাইকেলও চুরি হয়। পরিচিত একজনের মাধ্যমে চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলের মালিক এরশাদ আলী খবর পান, তার মোটরসাইকেলটি বিক্রি করতে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে ফেসবুকে। বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে বিক্রেতার সাথে কথা বলেন তিনি। দরদাম ঠিক করে সেটি কিনতে ১৬ জানুয়ারি আসেন লালখান বাজারে। সেখানে গিয়ে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ রাজু নামের চোরচক্রের একজনকে হাতেনাতে আটক করে।
এনআইডি সংশোধনের ফাঁদ : জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে ভুক্তভোগীরা জানেন কী জ্বালা। সংশোধন করতে গিয়ে জেরবার, অর্থ আর সময়ের অপচয়ে হয় বিরক্তি। আর এই সুযোগে ‘ব্যবসা ফেঁদেছে’ কয়েকটি চক্র। ফেসবুকে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা এক দিনেই নাম সংশোধন করে দেয়ার কথা বলছে। এ জন্য তাদের দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এর মধ্যে ফেসবুকে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র হেল্পলাইন’ নামে একটি পেইজের সন্ধান পাওয়া গেছে। আকাশ মাহমুদ নামে একজন সেটি পরিচালনা করেন।
ফেসবুকে এসএসসির প্রশ্নপত্র বিক্রি : ফেসবুকে চলতি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রির পোস্ট দিয়ে হিমেল মুস্তাকিম নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার হয়েছে সিআইডির হাতে। সোমবার (১ মে) সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার ফাঁসের গুজব ছড়ানোর অভিযোগে হিমেল মুস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয় সম্প্রতি ‘এসএসসি ব্যাচ–২০২৩’ নামে একটি গ্রুপে তার কাছে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আছে বলে একটি পোস্ট দেন হিমেল। ওই পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, শতভাগ কমন প্রশ্ন লাগলে দ্রুত যোগাযোগ করুন। প্রশ্ন পাবার সময়কাল পরীক্ষার দিন ভোর ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে। প্রতিজনের কাছ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা করে নেন তিনি। পুরো বিষয়টি সিআইডির সাইবার মনিটরিং টিমের নজরে এলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।