ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষার প্রতি দরদ বাড়ে। কিবোর্ডে ইংরেজি হরফে বাংলা লিখতে অস্বস্তি লাগে,অপরাধী মনে হয়,পাকিস্তানি শাসকচক্রের বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রের কথা, ভাষা শহীদদের রক্তের ঋনের কথা মনে হয়।
ভাষা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাসসহ সকল ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে প্রায় এক হাজার মাইলের অধিক ব্যবধানে অবস্থিত পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে অসম রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। ১৯৫১ সালের পাকিস্তানের প্রথম আদমশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬০% বাংলা ভাষাভাষী, ২৮.০৪%পাঞ্জাবী ভাষাভাষী, ৭.২%উর্দু ভাষাভাষী, ৭.১%পশতু ভাষাভাষী ও বাকীটা সিন্ধি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাভাষীর নাগরিক।
মূলতঃ পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে ভাষা বিতর্ক দেখা দেয়।১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা করার চেষ্টা করলে ফজলুল হকের বিরোধীতায় ব্যর্থ হয়।১৯৪৭ সালের মে মাসে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দিলে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কয়েকজন বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করে বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে “তমুদ্দিন মজলিশ “নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাষার প্রশ্নে সোচ্চার হয়।
পাকিস্তানের মুদ্রা,ডাকটিকেট,মানিঅর্ডার ফরম,রেলের টিকেট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হয়।পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলাকে বাদ দেয়া হয় শুধুমাত্র বাঙালিদের বঞ্চিত করার জন্য।এমন কি গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্বাচন করা হয়।
বাংলাভাষা নিশ্চিহ্ন করার জন্য ১৯৪৯-৫১ সালে সরকার আরবী হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র করে।১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য প্রাদেশিক সরকার একটি ভাষা কমিটি গঠন করে। এ কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঈ,ঊ,ঋ,৯,ঐ,ঙ,ঞ,ম,ষ,ঢ়,ক্ষ,ৎ,ঃ বর্ণ বাদ দিয়ে অ্যা বর্ণ যুক্ত করার পরামর্শ দেয়।কারণ এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো এসব বর্ণ সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে।যেহেতু সংস্কৃত হিন্দুদের ভাষা সেহেতু এসব বর্ণ ইসলামী রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য নয়।এভাবে শাসকশ্রেণী ভাষা নিয়েও সামপ্রদায়িক বিষ ছড়ায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সংগে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষার প্রস্তাব করলে তা নাকচ হয়ে যায়।যেহেতু প্রস্তাবটি একজন হিন্দু করে সেহেতু মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ প্রস্তাবে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান।প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই পাকিস্তানের ভাষা মুসলমানদের ভাষা উর্দু হওয়া উচিত।লিয়াকত আলীর এ ঘোষণার পর পূর্ব বাংলার ছাত্র -শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আপামর জনগণ বাংলা ভাষার দাবীতে এক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। ২রা মার্চ ১৯৪৮ ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে ১১মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। হরতাল চলাকালে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল আলমসহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১মার্চ ১৯৪৮ রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা অবশ্যই হবে উর্দুর ঘোষণায় উভয় অনুষ্ঠানে না-না ধ্বনিতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং ৪০সদস্য বিশিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সরকার ঢাকায় একমাসের জন্য ১৪৪ধারা জারী করে, আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের গুলিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ও পরবর্তীতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, ওয়াহিদুল্লাহ,আউয়ালসহ আরো অনেকের প্রাণের বিনিময়ে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা পায়।
কেন পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা সংখ্যা লঘিষ্ঠের ৭.২%উর্দু ভাষাকে আমাদের ৫৪.৬০% বাংলা ভাষাভাষীর উপর জুলুম করে চাপিয়ে দেয় তার কারণ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ,ব্যবসায়ী, আমলা ও প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিল উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী মোহাজের।এমন কি পূর্ব বাংলার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ইস্পাহানী, আদমজীসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী যারা মুসলিম লীগ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ছিলেন উর্দুভাষী। স্বভাবতই নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য উর্দুর পক্ষ নেন। মূলত বৃটিশদের মতো ঔপোনিবেশিক কায়দায় আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে শোষণ করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমাদের দাবায়া রাখতে পারবানা, দাবায়া রাখতে পারেনি। নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। গৌরবের বিষয় সিয়েরালিওনে বাংলা এখন তাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা।
আমাদের সন্তানদের নামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়ে আমরা খুশী হই। সন্তানরা টুকটাক ইংরেজি বা অনর্গল ইংরেজী বললে বা বাংলা ঠিকমতো বলতে না পারলে আমরা আত্নতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।একবারও ভাবিনা যে ভাষার জন্য আমাদের সত্তায় রক্তক্ষরণ হয়েছে তাকে অবহেলা করি কীভাবে? অবশ্যই প্রতিটি বাঙালিকে মাতৃভাষা চর্চা করতে হবে পাশাপাশি ইংরেজি বা অন্যান্য বিদেশী ভাষার দক্ষতা অর্জনের মধ্যে দোষের কিছু নেই। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার থাকতে হবে। ফেব্রুয়ারী এলেই আমাদের একুশের চেতনা জাগ্রত হয়। বাকী সময় চেতনা শীতনিদ্রায় থাকে।ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে রাখতে হবে তবেই ভাষাপ্রেম-দেশপ্রেম জাগ্রত হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক; ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, বি এড কলেজ- চট্টগ্রাম।