সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে রাষ্ট্রের ভূমিকা জরুরি

সৈয়দ দিদার আশরাফী | সোমবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তি যুগে আকাশচুম্বী অগ্রযাত্রা বেড়েছে। অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্য প্রবাহকে নীতিবাচক শব্দে নিমজ্জিত করছে একটি অমানবিক সিন্ডিকেট চক্র। এই চক্রটি নীতিবাচক তথ্য প্রবাহ প্রচার-প্রসারে ব্যস্ত। প্রবাদ আছে ‘মেঘ দেখে তুই করিসনি ভয়, আঁড়ালে তার সূর্য হাসে’। বিশ্বব্যাপী নীতিবাচক প্রবাহের পাশাপাশি মানুষ সিংহভাগ ইতিবাচক তথ্য প্রবাহকে বেছে নিচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতায় মানুষ বরাবরই সত্যের স্লোগান নিয়ে বিশ্বব্যাপী এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। প্রসঙ্গত বিশ্বব্যাপী অনলাইন প্রতারণা, অপরাধ প্রবণতা এবং গুজব ছড়ানোর বিষয়টি নতুন নয়। দিন দিন প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, সাইবার প্রতারকরাও তার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের দক্ষ করে তুলছে। এটা তাদের মিশন ও ভিশন। তবে যারা সাধারণ অনলাইন ব্যবহারকারী তাদের পক্ষে প্রযুক্তির অগ্রগামীতার সাথে তাল মেলানো কঠিন। ফলে তারা সাইবার প্রতারকদের দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। যুক্তি দেয়ার অপেক্ষা রাখে না, দেশের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরির সুযোগ, বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়ার সুযোগ, লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জনের মতো বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে গড়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্রকে পুঁজি করে প্রতারক চক্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এক্ষেত্রে মোবাইল অনলাইন প্রতারণা সিংহ ভাগ পরিলক্ষিত হয়েছে। সিন্ডিকেট চক্র গ্রুপ খুলে বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন ও কথামালার মাধ্যমে অনলাইন ব্যবহারকারীদের প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করে চলেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, সাইবার অপরাধী চক্র বিভিন্ন ভুয়া গ্রুপ পেইজ খুলে তরুণ-তরুণীদের চাকরি সুযোগ দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চাকরির গ্রুপে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ইনভাইট করে যোগ দেয়ার আহবান জানায়। এসব গ্রুপে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রতিদিন মাত্র দুই ঘন্টা সময় ব্যয় করে লেখালেখি করে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা উপার্জন করার লোভনীয় অফার থাকে। তাদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত হয়ে লেখা জমা দেয়া এবং আগ্রহীদের পরিচিতজনদের যুক্ত করার কথাও বলা হয়। এসব গ্রুপে যোগ দিতে আগ্রহীদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ৬০ বা তারও বেশি টাকা গ্রুপ অ্যাডমিনকে বিকাশ বা অন্যান্য মাধ্যমে পাঠাতে হয়। এতে স্বল্প সময় ব্যয় করে মাসে ভাল অর্থ আয়ের লক্ষ্যে তরুণ-তরুণীরা প্রলুব্ধ হয়ে এসব ভুয়া গ্রুপে যোগ দেয় এবং অন্যদেরও যুক্ত করে। গ্রুপে আড়াই-তিনশ’ সদস্য হওয়ার পর মাস শেষ হওয়ার আগেই প্রত্যেকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অর্থ নিয়ে তারা উধাও হয়ে যায়। সদস্যরা আর গ্রুপ খুঁজে পায় না।
প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সাইবার ওয়ার্ল্ডে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও নতুন নতুন অ্যাপ যুক্ত হচ্ছে। আজ যা নতুন, কাল তা পুরনো হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে আপগ্রেড হচ্ছে। পরিবর্তনের এ গতি এতটাই দ্রুত ঘটছে যে, সাধারণ অনলাইন ব্যবহারকারীর পক্ষে তা সহজে বোঝা বা ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রের প্রতারক চক্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের এ ধারার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ হচ্ছে, তারাও ভাল করে জানে নতুন প্রযুক্তি ও আইডিয়ার সাথে সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে তাল মেলানো সম্ভব নয়। ফলে আধুনিক প্রযুক্তি ও আইডিয়াকে তারা ত্বরিৎ ব্যবহার করে প্রলুব্ধকর নানা বিষয় উপস্থাপন করে। এতে সাধারণ ব্যবহারকারীরা তাদের গ্রুপ ও বিভিন্ন লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ হয়ে সাইবার অপরাধীদের ফাঁদে পড়ে। যখন বুঝতে পারে, ততক্ষণে অপরাধীরা তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে সটকে পড়ে। এসব গ্রুপের অ্যাডমিন কে এবং কারা এর সাথে যুক্ত তা প্রতারিতরা যেমন দেখতে পায় না, তেমনি খুঁজেও পায় না।
অন্যদিকে, সাইবার প্রতারকরা দক্ষ ও অভিজ্ঞ হওয়ায় এক গ্রুপ দিয়ে প্রতারণা শেষ করে নতুন অন্য গ্রুপ খোলে। বিশ্বব্যাপী এই সাইবার অপরাধী চক্র সক্রিয়। আমাদের দেশের অনলাইন ব্যবহারকারীদের অধিকাংশ অনভিজ্ঞ হওয়ায় সহজেই এ চক্রের ফাঁদে পড়ে। অনলাইনে সাধারণ কেনাকাটা করতে গিয়েও তারা প্রতারিত হয়। এক পণ্যের অর্ডার দিলে নিম্নমানের অন্য পণ্য দিয়ে প্রতারক চক্র প্রতারণা করে। এসব ক্ষেত্রে প্রতারিতদের কিছু করার থাকে না। তবে অনলাইনে এসব প্রতারক চক্রের পাশাপাশি জেনুইন বাণিজ্যিক এবং বিভিন্ন উপকারী গ্রুপও থাকে। কোনটা আসল আর কোনটা নকল বা প্রতারক গ্রুপ তা অনলাইন ব্যবহারকারীদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে যুক্ত হলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
সাইবার অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর সাথে যুক্তরা অত্যন্ত ইক্যুইপড, কৌশলী ও দক্ষ হওয়ায় তাদের সহজে চিহ্নিত করা দুষ্কর। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ভুক্তভুগীরা অভিযোগ করলেও পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি সুবিধা না থাকায় অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। আদালতেরও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। যেহেতু প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে, নিত্য নতুন কনটেন্ট সামনে আসছে, তাই এর সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিটিআরসিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইবার অপরাধীদের চিহ্নিত করতে তাদের চেয়েও দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ এবং জনবল গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদেরও পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। সাইবার অপরাধ দমনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে, আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রযুক্তির পরিবর্তন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ টিম গড়ে তোলা অপরিহার্য। এখানে উল্লেখ্য যে, সাইবার ক্রাইম কিংবা অবাধ তথ্য প্রবাহের নীতিবাচক দিকগুলো প্রতিরোধ করতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেশি করে ভাবতে হবে। এছাড়া স্ব স্ব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাইবার অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে আমাদের বিশ্বাস অনেকাংশে সাইবার ক্রাইম অপরাধ সংকুচিত হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটা ছোট্ট ম্যাসেজ
পরবর্তী নিবন্ধফেব্রুয়ারি এলেই একুশের চেতনা জাগ্রত হয়