বাসটি চলছিল সামনের দিকে। শহরের স্বাভাবিক গতির তুলনায় বেশ দ্রুতই চলছিল গাড়িটি। গতিও বেশ। পেছনে সমানতালে চলছিল একটি প্রাইভেট কারও। একেবারে আচমকা সামনের বাসটি জিইসি মোড়ের মেডিয়ান গ্যাপ দিয়ে ডানে মোড় নিল। আর পেছনের প্রাইভেট কারটি সজোরে ধাক্কা দিল বাসটিকে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার এই ঘটনার সময় বাসটি ডানে মোড় নেয়ার আগে কোনো সিগন্যাল দেয়নি। পরে দেখা যায় যে, বাসটির ডানদিকের ইন্ডিকেটর লাইটই নেই। ভেঙ্গে পড়ে গেছে। শুধু ডান দিকের ইন্ডিকেটর লাইটই নয়, বাসটির বেক লাইটও নেই। প্রাইভেট কারটির জায়গায় অন্য বাস বা ট্রাক হলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো। শুধু এই একটি বাসই নয়, চট্টগ্রামে চলাচলকারী বহু গাড়িই ঠিকঠাক নেই। কোন ধরণের ফিটনেসের তোয়াক্কা না করে এসব গাড়ি রাস্তা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সৃষ্টি করছে ঝুঁকির। গতকালের হিসেব অনুযায়ী চট্টগ্রামে প্রায় ৬০ হাজার গাড়ির কোন ফিটনেস নেই। এসব গাড়ির কোন কোনটি দুমড়ে মুচড়ে রয়েছে, কোনটির লাইট নেই, কোনটির এক লাইট জ্বলে তো অপরটি জ্বলে না। কোনটির ওয়েফার নেই। কোনটির কাচ নেই। অথচ গাড়িগুলো বছরের পর বছর ধরে দিব্যি চলাচল করছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় মানুষের জানমালের ব্যাপক হুমকির পাশাপাশি সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্বও ফাঁকি দিচ্ছে। কোন ধরণের ট্যাঙ না দেয়া এবং গণমানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা এসব গাড়ির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের দাবি তোলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিআরটিএর দুইটি বিভাগ থেকে গতকাল প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫১৬টি। এর মধ্যে ১ লাখ ৫২ হাজার মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলের কোন ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। বাকি ১ লাখ ৬২ হাজার ৫১৬টি গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেটের আওতায় রয়েছে। এসব গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করানোর সময় ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়েছে। যেগুলো এক দুই বছর পরপর নবায়ন করতে হয়। ফিটনেস করার সময় ইনকাম ট্যাঙ এবং ট্যাঙ টোকেন মিলে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় করে। কিন্তু চট্টগ্রামে বহু গাড়িই রয়েছে যেগুলো রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেয়ার পর আর ফিটনেস করাতে বিআরটিএ মুখো হয়নি। কোন কোনটি প্রথম কয়েক বছর ফিটনেস করালেও পরবর্তীতে আর করাচ্ছে না।
গতকাল প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী চট্টগ্রামে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৬টি গাড়ির ফিটনেস নিয়মিত রয়েছে। বাকি ৪৫ হাজার ১৩০টি গাড়ির ফিটনেস নেই। এই হিসেব শুধু রেজিস্ট্রেশন করানো গাড়ির। রেজিস্ট্রেশন করানো ছাড়া গ্যারেজ নম্বরসহ নানা পন্থায় শহরে চালানো গাড়িগুলো এই হিসেবের বাইরে রয়েছে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি টেঙি কোন ধরণের ফিটনেস এবং হিসেব নিকেশ ছাড়াই চলাচল করছে। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, চট্টগ্রামে ৬০ হাজারেরও বেশি গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলাচল করছে। এরমধ্যে প্রাইভেট কার, জীপ, বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংক লরি এবং সিএনজি টেঙি রয়েছে। শহরে চলাচলকারী রেজিস্ট্রেশনবিহীন অন্তত ১৫ হাজার সিএনজি টেঙিরই কোন ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। এছাড়া ২ হাজার ৯৯টি বাস, ৩৬ হাজার প্রাইভেট কার এবং প্রায় ৩০ হাজার ট্রাক কাভার্ড ভ্যান এবং কন্টেনার মোভারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশেরই ফিটনেস নেই। বন্দর এলাকায় চলাচলকারী বহু ট্রাকের লাইট ওয়েফারতো দূরের কথা, দরজা পর্যন্ত নেই। রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় লাইটই এক ড্রাইভারের সাথে অপর ড্রাইভারের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। সেই লাইটই নেই বহু গাড়িতে। শুধু ইন্ডিকেটর লাইটই নয়, হেডলাইট জ্বলে না কিংবা একটি জ্বলে এমন গাড়ির সংখ্যা শত শত। অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও ওয়েফার গাড়ির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৃষ্টির দিনে এই ওয়েফার ছাড়া গাড়ি চালানোর মাধ্যমে বড় ধরণের ঝুঁকির সৃষ্টি করে বহু বাস ট্রাক কাভার্ড ভ্যান কিংবা ট্যাংক লরি। সামনের কিছু না দেখলেও তারা দিব্যি দাবড়িয়ে চলে যায়। আর এতে করে বিভিন্ন সময় ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামে ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করে একাধিক যাত্রী গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, গণপরিবহন হিসেবে যেসব গাড়ি চলাচল করছে সেগুলোর অধিকাংশেরই ফিটনেস নেই। কিছু গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকলেও প্রকৃতপক্ষে গাড়িগুলোর অবস্থা বেহাল। যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলে গণপরিবহন হিসেবে চলাচলকারী চট্টগ্রামের অধিকাংশ গাড়িই ফিটনেস পাওয়ার কথা নয়। ২৫/৩০ থেকে ৪০/৫০ বছরের পুরানো বহু গাড়িও রাস্তা দাবড়ায় বলে তারা মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোন গাড়ি বিআরটিএতে আসলে সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। তবে চট্টগ্রামে একটি গাড়িও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে ফিটনেস পরীক্ষা হয় না। বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা খালি চোখে দেখে ফিটনেস পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট ইস্যু করে। চট্টগ্রামেও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করা হলে সংকট কিছুটা কমে আসবে। তবে এগুলো হচ্ছে যেসব গাড়ি বিআরটিএতে আসে সেগুলোর ব্যবস্থা। কিন্তু কোন গাড়ির মালিক যদি বিআরটিএতে না–ই আসেন তাহলে তাকে ধরে এনে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করানোর সুযোগ বিআরটিএর নেই। তবুও বিভিন্ন সময় বিআরটিএ নগরীতে অভিযান পরিচালনা করে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। তিনি কাজটি মূলতঃ পুলিশের বলেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পুলিশই রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। কোন গাড়ির ফিটনেস না থাকলে সেটি পুলিশের জব্দ করার কথা। পুলিশ না চাইলে রাস্তায় কোন ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে পারবে না বলেও ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে নগর ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শহরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল ঠেকাতে পুলিশ প্রতিদিনই অভিযান চালায়। প্রতিদিনই বহু গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। জরিমানা করা হয়। তবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু ফিটনেসবিহীন গাড়ি নগরীতে চলাচল করে বলেও তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, গণপরিবহনগুলোতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেশি। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে কিছু সমস্যাও হয়। পুলিশকে সবদিক মাথায় রেখে কাজ করতে হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে সিএমপির নির্দেশনা এবং প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যাপারে আমাদের কাছে সাম্প্রতিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে পরিসংখ্যান যা–ই বলুক, খালি চোখেই হাজার হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ির আনাগোনা দেখা যায়। তিনি বলেন, ঢাকায় ২০ শতাংশ ফিটনেস সমৃদ্ধ গাড়ি আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে এক শতাংশও নেই। তিনি বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সংঘবদ্ধ চক্র পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে। এসব দেখভালের জন্য যাদের রাখা হয়েছে তারাই এই চক্রের সাথে জড়িত। এই অবস্থায় ফিটনেসবিহীন গাড়ির ঝুঁকি থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি বা আরটিসি নামে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি থাকলেও এই কমিটি দৃশ্যমান কোন ভূমিকা ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নেয়নি।
অপর একজন নেতা চট্টগ্রামে চলাচলকারী গণপরিবহনের ৯৫ শতাংশ অনুপযুক্ত। ফিটনেস দেওয়ার পদ্ধতিতে গলদ আছে। সড়কে আইনের প্রয়োগও কম। গলদ সারতে সব স্থানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা মন্তব্য করেন।