সবুজ ঘাসে মুড়িয়ে নেয়া যে লম্বা রাস্তাটা সোজা চলে গেছে মুসলিম পাড়া অবধি, তার দুইধারে এই ফাল্গুনে তারার মতো ফুটে থাকতো ভাঁটফুল। একদম সাদা, মিহি গন্ধের ভাঁটফুলে, আলো হয়ে উঠতো এই রাস্তাটা। সেকি অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, দুইধারে ফুটে ওঠা ভাঁটফুলের! সেই মুগ্ধতা আজও রয়ে গেলো, এত এত বছর পরেও। বাড়ির সীমানা শেষে পূর্ব দিকের ওই দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত দেখে ভাবতাম শৈশবে, এরপরে ঐ বিশাল আকাশ। আর তাতেই প্রতিদিন সূর্য ওঠে। তারপর আর কিছু নেই। শৈশবের চৌহদ্দি পেরিয়ে যখন আমি একটু বড় হলাম, জানতে পারলাম সেই লম্বা রাস্তাটা মুসলিম পাড়ার দিকে চলে গেছে। আর সে পাড়ায় আমাদের মতোই মানুষেরা থাকে। ভাবলাম এর পর ওই বিশাল আকাশ, আর তাতে প্রতি পূর্ণিমায় থালার মতো বিশাল এক চাঁদ ওঠে। সেই সাপের মতো লম্বা রাস্তাটা পেরিয়ে আবার দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত। যখন বয়স পেরিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম সামনের সময়ে, তখন জানলাম, মাঠের পরে সেই মাঠ পেরিয়ে যেখানে আকাশ মিশেছে দিগন্তসীমা ছাপিয়ে, সেই সূর্য ওঠা, চাঁদ ওঠা আকাশের গায়ে লেগে আছে আরেকটি ছোট্ট পাড়া। ভাবতাম ওরা অন্যদেশের লোক। ছোটো ছিলাম কিনা! তারপর, সেই বছরগুলোকে শৈশবের তকমা লাগিয়ে দিয়ে যখন আমি স্থির কৈশোরে, যখন আমি ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাড়ি, পাড়া আবিষ্কারের নেশায় ঘর ছাড়লাম, তখনিই এমন দীর্ঘদিনের অলস দুপুরে স্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের দলে ভিড়ে আমি গিয়েছিলাম সেই মাঠের পরে মাঠ পেরিয়ে দিগন্তের কোলে লেপ্টে থাকা গ্রামখানি দেখতে। বিশাল বহরের সেই তেঁতুল গাছের নিচে ছোট্টো একটি পাড়া। ছায়াঘন, নির্জন, ঠাণ্ডা শীতল হাওয়ায় ছোটো ছোটো মাটির ঘরগুলোতে কী পরম প্রশান্তি মাখানো ঝিম ধরা দুপুর। পুকুরের টলটলে জলে বাতাসের সেকি খেলা। এই মধ্য ফাগুনে সেখানে গামারি গাছ থেকে ঝরে পড়া হলুদরঙা ফুলের সেকি রূপ, সেকি মিহি গন্ধ! সেখানে সাদাটে সজনে ফুলে মৌমাছির গুণগুণ শব্দে এখনও সময় বয়ে চলে হয়তো। ছোটো ছোটো মাটির ঘরে সেখানে জীবনের পালা চলে ক্রমাগত। জীবন সেখানে জলের মতোই। যখন যেমন, তেমনিই তার অবয়ব। সেখানে হয়তোবা ঈশ্বর থাকেন না, কারণ কৈশোরেই শিখেছিলাম, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে’! সেই তেঁতুলগাছের ছায়ায় মোড়ানো ছোট্টো সুন্দর ঘরগুলো এখনও মনের এককোণে এতটা শান্তি এনে দেয়, তা অবর্ণনীয়। আজ এত এত বছর পেরিয়ে এই মধ্য ফাগুনে ভাবছি সেই সুন্দর পরিপাটি বাড়িগুলোর কথা,যেখানে নিকোনো উঠোনে টুপটাপ আমের মুকুল ঝরে পড়ে। কাঁঠালিজবার গন্ধে যেখানে ফাগুন সন্ধ্যা নামে। ফাগুন পূর্ণিমায় কী অপার্থিব সৌন্দর্য নেমে আসে সেই উঠোনে, বাড়ি লাগোয়া ধানক্ষেতে। সমস্ত চরাচরজুড়ে শুধু রূপোলী আলোর রোশনাই। সেখানে পদ্মপুকুরের টলটলে জলে চাঁদের ছায়া পড়ে। এই পার্থিব জগতের সমস্ত মলিনতা ধুয়ে যায় চাঁদের রুপোলি আলোয়, চকচকে হয়ে ওঠে ধরাতল। ভাঁটফুল তার মিহি ঘ্রাণ ছাড়তে শুরু করে। বুনোফুলের মাতাল গন্ধে রাতপরির ডানায় ভর করে হয়তো নিশুতি রাত! নির্মেঘ, নির্মল আকাশ, আর তাতে বুনোফুলের মাদকতা মেশানো ফাগুনের পাগলাটে বাতাসে–প্রহরে প্রহরে সেখানে রাতের সৌন্দর্য বাড়ে বুনোফুলের গন্ধে, হুট করে মাঝরাতে কোকিলের গেয়ে ওঠায়, চাঁদের আলোয় পলাশ–শিমুলের শুভদৃষ্টিতে, আর ফাগুনের পাগলাটে বাতাসে মনে পড়ে যায় নজরুলের উদাত্ত আহবান ‘চৈতালী চাঁদনী রাতে, নবমালতী কলি, মুকুল নয়ন মেলি নিশি জাগে আমারি সাথে’!