পড়াশোনার মান, ব্যবহারিক দিক ও পর্যাপ্ত সুযোগ

রানা বড়ুয়া | সোমবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের পড়াশোনা নিয়ে অনেক অভিযোগ। স্কুলে ভালো শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকরা ভালোমতো ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করেন না, এমন অনেক কিছু। এর মাঝেও শহর ও গ্রামের ভালো স্কুলগুলোতে যে সব ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে তাদের পড়াশোনার মান আমার মতে বেশ ভালোই।
কী করে আমি এটা বলছি?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে এই উপলব্ধি হয়েছে আমার। আমাদের পড়াশোনা এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও বেশ ভালো। বাংলাদেশ থেকে যত ছাত্র-ছাত্রীর পরিবার ইমিগ্র্যান্ট সুবিধা বা ডাইভার্সিটি ভিসা নিয়ে আগে এসেছে বা যে সব পরিবার রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বৈধ হয়েছে বা আশ্রয়ে আছে সবার ছেলেমেয়েদের স্কুলের ফলাফল বেশ আশাপ্রদ। প্রতিটা স্কুলের ক্লাস শিক্ষক বা শিক্ষিকা এ কথা স্বীকার করেন যে এসব ছাত্র-ছাত্রীরা অংকে বেশ ভালো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুলের বাৎসরিক বাজেট দেখলে দেখবেন এটা আমাদের দেশের অনেক বিদ্যালয়ের সম্মিলিত বাজেটের চেয়েও বেশি।
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার বেতনও আমাদের তুলনায় এত বেশি যে তা আমাদের সাথে তুলনা শুধু লজ্জাজনকই নয় তুলনা করাও সমীচীন নয়।
এত বেতনধারী ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠদানের মান আমাদের দেশের কম বেতনভোগী শিক্ষক-শিক্ষিকার চেয়ে বেশি তো নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে কম। তাই প্রবাসে এসে দেশের কম সুযোগসুবিধা পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে গেছে।
দেশে শিক্ষক-শিক্ষিকার মান আরও ভালো হতো যদি সঠিকভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। যা হউক আমার আজ লিখার কারণ আমরা ভালো ছাত্র পেয়েও কেন উন্নত কিছু করতে পারছি না।
অথচ এইসব ছাত্র-ছাত্রীরা যখন স্কলারশিপ বা ট্রেনিং নিয়ে বিদেশ গমন করে তখন তারা সেদেশে বেশ দক্ষতা প্রদর্শন করে। তা হলে দেশে পারছে না কেন?
এর প্রধান ও প্রথম প্রতিবন্ধকতা হলো পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব। সুযোগ মানে সঠিক সামগ্রী বা প্রায়োগিক সামগ্রীর অভাব। বর্তমান যুগে শুধু মাথার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সামনে এগুনো যায় না তার জন্য দরকার যন্ত্রপাতিও।
সামান্য উদাহরণ দেই–ক্যালকুলেটর প্রয়োগ করে উচ্চশ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা যত দ্রুত সমাধান করতে পারবে তা ব্যবহার না করেও সে পারবে এক্ষেত্রে সময় অপচয়ে হবে-সে পিছিয়ে যাবে। বর্তমান দুনিয়ায় সময় একটা মূল্যবান সম্পদ।
বিশেষায়িত যন্ত্রের ব্যবহারে কত সুবিধা তা তো দেশ এবার দেখেছে। কৃষকের ধান কাটা যন্ত্রের ব্যবহারে এই মহামারী সময়েও কত অল্প সময়ে দুর্যোগ আসার আগেই সমস্ত ধান কাটা শেষ করা গেছে।
আমি বাস্তবিক একটা উদাহরণ দিতে চাই।
সাম্প্রতিক সময় আমি প্রকৌশলী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি যে সংস্থায় কর্মরত আছি তাতে কিছু ইন্টার্ন নিয়োগ দেয়া হয়। এদেশে প্রতিটা সংস্থায় ইন্টার্ন নিয়োগ দেয়া হয় বছরের যে সময় কলেজ বন্ধ থাকে সেই সময়।
এ বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তা প্রায় বন্ধ ছিল কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এটা গবেষণা ধরনের কাজ বলে বাসায় বসেও করার উপযুক্ত ছিল। তাই আমরা ইন্টারভিউর মাধ্যমে চারজন ইন্টার্ন নিয়োগ দেই যারা অনলাইনে দরখাস্ত করেছিল।
চারজন ইন্টার্নের একজন প্রথম বছর শেষ করেছে কম্পিউটার সায়েন্সে, একজন দুই বছর শেষ করেছে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড কম্পিউটিংয়ে, আর দু’জনের তিন বছর সম্পন্ন হয়েছে একজনের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যজনের কম্পিউটার সায়েন্সে।
তাদের আবার বেতনও দেয়া হয় ঘণ্টায় ১৭.৫০ ডলার করে অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রতি ঘণ্টায় প্রায় দেড় হাজার টাকা। লক্ষ্য শুধু টাকা দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য উন্নত প্রকৌশলী বের করে আনা যারা প্রকৃত জীবনে যাওয়ার আগেই যাতে বাস্তবিক জ্ঞানে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে।
এটা তো আমাদের দেশে কল্পনা করাও দুরূহ অথচ সরকারি নির্দেশনা থাকলেই যেকোনো শিল্প-কারখানা এ ধরনের সুযোগ দিতে বাধ্য। দেশে কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব সুযোগ আছেও।
এই চারজনকে চারটি প্রজেক্ট দেয়া হয়েছিল। প্রজেক্টকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা হয়।
প্রতি ধাপের শেষে কাজের অগ্রগতি নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। এর ফাঁকে তাদের ফিল্ড নিয়ে ব্যবহারিক কাজ কীভাবে হয়, কীভাবে ডিজাইন ও প্রজেক্ট ডকুমেন্ট তৈরি হয় তাও জ্ঞান দেয়া হয়েছে।
মাত্র দেড় মাসে তারা ছাত্র অবস্থায় প্রতিটা প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছে এবং শেষে একটা ফাইনাল প্রেজেন্টেশন দিয়ে সম্পূর্ণ প্রজেক্টের রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
এসব ইন্টার্নদের মধ্যে কোনো ফাঁকির প্রবণতা ছিল না কারণ তারা জানে তারা বেতনভুক্ত।
আমি দেখেছি তারা সবাই আমাদের দেশের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতোই জ্ঞানসম্পন্ন কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা ও পর্যাপ্ত সুযোগ মানে অনুষঙ্গ পেয়ে তারা এক একজন যে কাজ সম্পন্ন করেছে তা দেশের অনেক প্রকৌশলীর পক্ষেও করা সম্ভব নয় যদিও তাদের জ্ঞান আছে কিন্তু সুযোগ কোথায়?
পাঠকদের পরিপূর্ণ বিষয়টি বোঝার জন্য দু’জন ইন্টার্ন যাদের ৪ বছরের শিক্ষা বর্ষের একজন মাত্র প্রথম বর্ষ ও অন্য জন দুই বছর শেষ করেছে তাদের ফাইনাল প্রেজেন্টেশন ও কিছু প্রশ্ন উত্তরের ভিডিও নিচের লিংকে দেয়া হলো
https://www.youtube.com/watch?v=WetfzLHZ4hg&feature=youtu.be

https://www.youtube.com/watch?v=6Swa0m2xtb8&feature=youtu.be

আমি বিশ্বাস করি দেশের প্রতিটা শিল্প প্রতিষ্ঠান আকারভেদে যদি অন্তত ১০-২৫ জন ইন্টার্ন প্রতি বছর নেয় তাহলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে উঠবে।
এতে সামগ্রিক অর্থে দেশেরই লাভ। এসব ইন্টার্ন থেকেও আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনি হয়ত পেয়ে যাবেন ভবিষ্যতের ভালো প্রকৌশলী।
লেখক: ইনটেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, নিউইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অভ ট্রান্সপোর্টেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ই-মেইল: successtutorialinfo@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে ধর্ষণ-ডাকাতির কথা স্বীকার করেছে ৬ জন
পরবর্তী নিবন্ধশিশুকে নির্মম নির্যাতন সৎ পিতা গ্রেপ্তার