প্লাস্টিক পলিথিনে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি, কর্ণফুলীর জন্য হুমকি

নিষিদ্ধ থাকলেও ব্যবহার কমছে না দূষণে ক্ষতি অনেক, কী করছে পরিবেশ অধিদপ্তর

মোরশেদ তালুকদার | সোমবার , ৫ জুন, ২০২৩ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

শুধু পরিবেশ দূষণ নয়, প্লাস্টিক ও পলিথিনের অবাধ ব্যবহারে জলাবদ্ধতারও ঝুঁকি বাড়ছে নগরে। এছাড়া পানি দূষণ, দুর্গন্ধসহ নানা সমস্যার জন্য দায়ী প্লাস্টিক ও পলিথিন। মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো আছেই। একই সঙ্গে প্লাস্টিকপলিথিনের কারণে দিন দিন নাব্যতা কমছে কর্ণফুলী নদীর। বাড়ছে এ নদীর জলজপ্রাণীর মৃত্যুও। নগরের সবগুলো বাজারে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এছাড়া পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার রোধে আছে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন১৯৯৫ (সংশোধিত ২০০২) আইনও। নির্দিষ্ট পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহারেও আইন আছে। এরপরও পলিথিনপ্লাস্টিকের ব্যবহার কমছে না নগরে। বরং বাড়ছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, নগরে ২০২২ সালে দৈনিক ২৪৯ টন প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়; যা দৈনিক মোট উৎপাদিত বর্জ্যের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ২০৩২ সালে ৩১৩ টন, ২০৪২ সালে ৩৬৯ টন এবং ২০৫২ সালে দৈনিক ৪২৮ টন প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য উৎপাদিত হবে। জানা গেছে, চারটি উৎস থেকে নগরে বাড়ছে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। এগুলো হচ্ছে শিল্পকারখানা, কৃষি খামার, বাণিজ্যিক এবং গৃহস্থালী।

জলাবদ্ধতার ঝুঁকি ও কর্ণফুলীর জন্য যেভাবে হুমকি : জাইকার বর্জ্য বিষয়ক এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, নগরে দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কর্পোরেশন সংগ্রহ করে ২ হাজার টন। বাকি বর্জ্য নালানর্দমা, খালবিল, নদী ও উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে। ওই হিসেবে সংগ্রহ করতে না পারা বর্জ্যের মধ্যে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যও রয়েছে।

নগরে ৩০০টি নিবন্ধিত দোকান বা প্রতিষ্ঠান আছে যারা প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় বর্জ্য সংগ্রহ করে। তারা দৈনিক ১০৯ টন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে। বাকি ১৪০ টন সংগ্রহের বাইরে থাকে। এর কিছু কর্পোরেশন সংগ্রহ করে। বাকিগুলো পড়ে থাকে। এগুলো খালনালায় পড়ে ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। আবার খালনালা হয়ে তা পড়ে কর্ণফুলীতে। এতে কমছে কর্ণফুলীর নাব্যতা।

চুয়েটের গবেষণার তথ্য অনুয়ায়ী, চট্টগ্রামে সংগৃহীত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের মাত্র ৮৮ দশমিক ৬৬ টন রিসাইক্লিং করা হয়। বাকি বর্জ্যের মধ্যে ২০ দশমিক ৩৪ টন রিসাইক্লিং অযোগ্য হওয়ায় তা ডাম্পিং করা হয় বা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়।

জানা গেছে, নগরের ৩৩টি খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ আছে কর্ণফুলী নদীর। এসব খাল দিয়ে শহরে ময়লাআবর্জনা নদীতে গিয়ে পড়ে। এছাড়া নগর ও আশেপাশের সাতটি খাল দিয়ে বেশি বর্জ্য পড়ে কর্ণফুলীতে। এর মধ্যে পাঁচটি খালের অবস্থান শহরে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত খালগুলো দিয়ে প্রতিদিন কর্ণফুলীতে পড়ছে গৃহস্থালীর পাশাপাশি পলিথিন, প্লাস্টিকসহ অপনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্যের কারণে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারানোর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী।

কর্ণফুলী রক্ষায় প্রণীত মাস্টার প্ল্যানে বলা হয়, পলিথিন দ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার এবং যত্রতত্র নিক্ষেপ পানি দূষণের আরেকটি প্রধান কারণ। এটি যেমন জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী তেমনি জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য হুমকিস্বরূপ। বেশিরভাগ সময় কর্ণফুলী নদীর ডিও বা অঙিজেনের মান ৪ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৫ এর মধ্যে থাকে; যা উদ্বেগজনক। কারণ ডিও’র মান ৪এর নিচে নামলে তা পানিতে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের ‘সিপিডিগ্রিন সিটিজ ইনিশিয়েটিভ’ রিসার্চের অংশ হিসেবে প্রকাশিত সেকেন্ডারি ডেটায় উল্লেখ করে, কর্ণফুলীতে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ প্লাস্টিকের ঠাঁই হয়।

চুয়েটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, যত্রতত্র প্লাস্টিক ছুড়ে ফেলা, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন না থাকা, প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব, প্লাস্টিক পোড়ানো, প্লাস্টিক দূষণের কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, অপচনশীলতা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্লাস্টিক বর্জ্যে দূষণ দিন দিন বাড়ছে।

অন্যান্য ঝুঁকি : বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর ৬০ শতাংশ রাস্তাঘাট ও নদীতে যাচ্ছে; যা মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে ঢুকে এবং পরবর্তীতে তা মানুষের জীবনচক্র ও শরীরে চলে আসছে। ওই হিসেবে চট্টগ্রামবাসীও একই সমস্যায় ভুগছেন।

চুয়েটের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিকপলিথিন খাবার ও নিশ্বাসের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। প্লাস্টিকপলিথিনে কেমিক্যাল উপকরণ থাকে, যা ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব এবং অটিজমের মতো রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্লাস্টিকপলিথিন বর্জ্য পরিবেশে এসে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার (প্যাথোজেন) মতো অণুজীবকে আকর্ষণ করে, যা পরবর্তীতে প্যাথোজেন ধারণকারী মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি মানব দেহে প্রবেশ করে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত আজাদীকে বলেন, প্লাস্টিক মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আবার পরিবেশের জন্যও। তিনি বলেন, আইন থাকলেও মানুষ সচেতন না হলে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হবে না। প্রয়োজন সচেতনতা এবং এনফোর্সমেন্ট। এনফোর্সমেন্ট বলতে বলপ্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ওয়ার্ডভিত্তিক সংগ্রহ সেল করতে হবে।

কী করছে পরিবেশ অধিদপ্তর : পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক আজাদীকে বলেন, পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে নিয়মিত অভিযানসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

জানা গেছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত পলিথিন বিরোধী ৩টি অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর আগে গত কয়েক বছরে ৩০টি অভিযান পরিচালনা করে। এর আগে গত বছর অক্টোবরে রেয়াজুদ্িদন বাজারে অভিযান চালানোর সময় বাধার সম্মুখীন হন অভিযানে অংশ নেয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্র্তারা।

প্রসঙ্গত, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ
পরবর্তী নিবন্ধ৫-৮ জুন প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ